Hafizul Islam

সুনীলের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ও সত্যজিতের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ; অভিযোজনের তুলনামূলক বিশ্লেষণ

পড়েছেন: 1,388 জন পাঠক

সুনীলের রচনায় সত্যজিতের নির্মাণ, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ দুই ক্ষণজন্মা মানুষকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে একসারিতে। পূর্বের আলোচনায় আমরা উপন্যাস এবং চলচ্চিত্রের অভিযোজন, তুলনামূলক নানান বিষয় তুলে ধরেছি। এবারে একটু ভিন্নভাবে কিছু বিষয় আলোকপাত করছি।

সত্যজিৎ রায়ের নির্মাণ কুশলতা কিংবা চিত্রায়ণ ও সৃষ্টিশীলতা নিয়ে কোন সংকোচ কিংবা দ্বিধার অবকাশ নেই। অপরদিকে সুনীলের গ্রহণযোগ্যতা কিংবা সৃজণশীলতা অবশ্যই নমস্য। সত্যজিৎ যখন সুনীলের উপন্যাসে চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন, তখন একধরণের দ্বৈরথের আভাস পাওয়া যায়। সত্যজিৎ জীবনকে সবসময় ব্যক্তি মানুষের আঙিনা থেকে দেখেছেন। কলকাতা ট্রিলজির একটি চলচ্চিত্র এই ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’। যখন এই চলচ্চিত্র মুক্তি পায়, তখন সত্তরের দশক। ভারতবর্ষসহ সারা পৃথিবীতে একধরণের পালাবদল কিংবা অস্থিরতা চলছে। রাজনৈতিক মঞ্চে সাম্রাজ্যবাদের অস্তায়মান সূর্যের পাশ ঘেষে জাতীয়তাবাদের নতুন আবাহনী শোনা যাচ্ছিলো।

এইসময়ের রাজনৈতিক বয়ানের চিত্রায়ণ আমরা দেখি ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ তে। কিন্তু এই বয়ান কী সত্যজিতের ? নাকি, সুনীলের? এই দ্বন্দ্ব থেকেই আমরা অনুসন্ধান করি উপন্যাস এবং চলচ্চিত্রের নানা আলোচনা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও রিভিউ।  শক্তিমান সত্যজিৎকে কেউ দাঁড় করিয়েছেন কাঠগড়ায়। আবার আকিরা কুরোসাওয়ার মতো বরেণ্য নির্মাতা আমাদের জানাচ্ছেন সত্যজিতের কীর্তিময়তার কথা। এই দ্বান্দ্বিক বিষয়গুলো একটু সবিস্তার তুলে ধরছি।

প্রথমে আমরা আকিরা কুরোসাওয়ার উক্তি বাংলা অনুলিখনে তুলে ধরছি।

‘সত্যজিতের চলচ্চিত্র না দেখা আর পৃথিবীতে বাস করে চন্দ্র-সূর্য না দেখা একই কথা’। সত্যজিতের ছবিগুলো মোটেই ধীরগতির নয়। বরং এগুলোকে শান্তভাবে বহমান এক বিরাট নদীর সাথে তুলনা করা যায়।’

সমালোচকদের একটা উক্তি,

‘মিস্টার রে সোল্ড পভার্টি ভেরি ক্লেভার্লি’

 আরেকজন লিখেছেন,

“সিনেমার ভিতর দিয়ে দারিদ্র্য‌ বিকিয়ে দিয়ে পুরস্কার প্রাপ্তির যে গোড়াপত্তন তিনি করেছিলেন তা এখনও অত্র অঞ্চলের সিনেমায় আছর করে আছে। সমালোচকরা তাই বলেন ‘মিস্টার রে সোল্ড পভার্টি ভেরি ক্লেভার্লি’। ইউরোপিয়ান ফিচার ফিল্ম দ্বারা আক্রান্ত এবং পুতুপুতু মার্কা প্রেমের গল্পের নির্মাতা হিসেবে রয়কে বেশ শক্তিশালী মনে হয়না আমার। সেই সময়ে এসে ঋত্বিক কিন্তু আলাদা শক্তিমত্তা নিয়ে হাজির হন কেবলমাত্র সিনেমার রাজনীতি দিয়ে। বিভূতিভূষণ এর অপু ট্রিলজিকে পুঁজি করে রয় এক ধরণের প্রাচ্য দেশীয় দারিদ্রের ফর্ম  তৈরি করেছিলেন সেটা আমার কাছে কম প্রভাবক মনে হয়। মোসাহেব বা কুলীন লোকেদের সিনেমা বানাতে সত্যজিৎ অনেকাংশে এলিটমুখীন হয়ে উঠেছিলেন।”

আমরা এবার আলোচনায় আসি। সত্যজিৎকে ও তার চলচ্চিত্রকে বারবার বলা হয়েছে যে, তিনি রাজনৈতিক ছিলেন না। তার সিনেমা সামগ্রিক জীবনকে চিত্রায়িত করতো না। তিনি মনোজাগতিক কিংবা ব্যক্তিকেন্দ্রিক ন্যারেটিভে গল্প বলতে পারঙ্গম ছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে ক্রিশ্চিয়ান থমসন প্রশ্ন করেছিলেন- ‘যদি আপনি সত্যিকার রাজনৈতিক ছবিই করবেন ঠিক করেছিলেন তাহলে এই রাজনৈতিক চরিত্র টুলুকে কেন্দ্রীয় চরিত্র কেন করলেন না?’ উত্তরে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন- ‘কেন-না নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্বাস (লাইন) আছে এমন একটি ব্যক্তি প্রায়শই মনস্তাত্ত্বিক ভাবে কম চিত্তাকর্ষক হয়। বিপ্লবীরা সব সময়ে নিজেদের নিয়ে ভাবে না। আমি বরং সেই যুবকটির (সিদ্ধার্থের) প্রতি বেশি আগ্রহী যার কোনো দৃঢ় রাজনৈতিক বিশ্বাস নেই, সে চায় চাকরি, তা যে-কোনো রাজত্বেই হোক না কেন। সে ভাবে তার নিজের কথা এবং সে জন্য সে কষ্ট পায়।’

এইটুকু পাঠ করে সত্যজিৎকে পাঠ করা হয়ে যায় বলে মনে হতে পারে। মনে হতে পারে, ‘সত্যজিতের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি উদারনৈতিক এবং সেখানে রয়েছে অভিজাত শ্রেণীর রাজনীতি বিমুখ প্রবণতা।’ আসলেই কি তাই? আমাদের ভাবনার সাথে মিলে না। আমরা উত্তর খুঁজতে গিয়ে সত্যজিতের আরেকটা সাক্ষাৎকার খুঁজে পাই। সেখানে তিনি বলছেন,

প্রতিদ্বন্দ্বীতে আপনি আমার মনোভাব সম্পর্কে জানতে পারবেন। সেখানে দুই ভাই আছে, ছোট ভাই নকশালী। এব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে বড়ো ভাই ছোট ভাইয়ের সাহস ও অপরাধের ব্যাপারে তাকে সমীহ করে। ছবিটিতে কোনো অস্পষ্টতা নেই। কিন্তু একজন নির্মাতা হিসেবে আমি বড়ো ভাইয়ের ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ছিলাম। কারণ সে একটি দোদুল্যমান চরিত্র। একটি মানসিক অস্তিত্ব হিসেবে, দ্বিধাগ্রস্ত একজন মানুষ হিসেবে, চরিত্রটি আমার কাছে বেশি আকর্ষণীয়। ছোট ভাই ইতোমধ্যেই নিজেকে একটি দর্শনের মধ্যে খুঁজে পেয়েছে। এবং এটি তার পুরো চরিত্রকে তাড়িত করে, তাকে অগুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। নকশাল আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে। একজন ব্যক্তি হিসেবে সে তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ে। 

এবার আমাদের চিন্তায় আলো ফেলেন এই ক্ষণজন্মা নির্মাতা। আমরা বুঝতে পারি, ব্যক্তিমানুষের একান্ত নিজস্ব উঠানের গল্প তিনি করতে চান। যে গল্প প্রথমে মানুষের, তারপর সে গল্প সমাজের, পৃথিবীর।

একজন শিল্পী তার চারপাশের ঘটমান বাস্তবকে প্রথমে নিজের মনোজাগতিক ওয়ার্কশপে নিয়ে যান। তারপর নিজের আদর্শিক ও শ্রেণীগত অনুষঙ্গের নিক্তিতে পরিমাপ করেন। সবশেষে নিজের বিবেচনায় তুলে নেন ভাবনার নির্যাসটুকু। যখন তিনি কোন শিল্পের সৃষ্টিযজ্ঞে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তখন তার মৌলভিত্তি থাকে পূর্বেকার জমানো বিশ্বাস ও উপলব্ধিগত ভাবনার সারাংশ। সত্যজিৎ তাই করেছেন। বরং সত্যজিতের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার নিগুঢ়তা বুঝতে বরং তার সমালোচকরা বারবার ব্যর্থ হয়েছেন।

সত্যজিতের সাথে সুনীলের দ্বৈরথের বিষয়টি কীভাবে আসলো? দ্বৈরথের বিষয়টি এনেছেন সত্যজিৎকে বুঝতে ব্যর্থ সমালোচক শ্রেণী। তারা বলছেন,

উপন্যাসের সমাপ্তিটা চলচ্চিত্রের থেকে অনেক বেশি দ্রোহের মন্ত্রে উজ্জীবিত। প্রতিশোধ নিতে উন্মুখ সিদ্ধার্থের দেখা পাওয়া যায় সুনীলের উপন্যাসের শেষ অঙ্কে। সেখানে সিদ্ধার্থ ভাবছে, ‘ইন্টারভিউয়ের সেই লোকগুলো, চিবিয়ে-চিবিয়ে কথা বলছিল- আমি ওদের সবশুদ্ধ ধ্বংস করে দেবো, ওই বাড়িটা পর্যন্ত ধুলোয় গুঁড়ো করে ফেলবো, বাদল আর তার দুই সঙ্গী,… অনন্ত সান্যাল- ওর চোখ দুটো আমি উপড়ে নেবো, চেনে না আমাকে, সেই পুলিশ অফিসারটা, এমনকি কেয়ার বাবাও যদি ঘুষখোর হয়- সব্বাইকে দেয়ালে দাঁড় করিয়ে দিয়ে রাইফেল হাতে নিয়ে… দেখে নিয়ো, ঠিক আমি ফিরে আসবো!’

 সিনেমার শেষ দৃশ্যের কথা আমরা মনে করতে পারি। নায়ক বাড়ির ছাঁদে দাঁড়িয়ে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে, কিছু মানুষ একটি লাশ বহন করে শশ্মানে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের সম্মিলিত ধ্বনি ভেসে আসছে, ‘রাম নাম সৎ হ্যায়, রাম নাম সৎ হ্যায়’ । এই দৃশ্যটিকে সবকিছুর শেষ হয়ে যাওয়ার মতো মনে করছেন অনেকে। একজন হতাশ ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক মানুষের বিচ্ছিন্ন সময়ের সমাপ্তি যেনো। কিন্তু, আসলেই কি তাই?

সুনীলের সাথে সত্যজিতের এখানে এক ধরণের ন্যারেটিভেটিভ ডিফারেন্স লক্ষ্য করা যায়। সুনীল সবসময় সবিস্তার ব্যাকগ্রাউন্ডে ধীরে ধীরে একটি সামগ্রিক চিত্র আঁকেন। তাঁর রচিত প্রথম আলো, সেই সময়, পূর্ব-পশ্চিমের মতো মহাকাব্যিক ব্যাপ্তির গ্রন্থগুলো পাঠ করলেই সেই পরিপ্রেক্ষিতগত বিশালতা উপলব্ধি করা সম্ভব। সুনীল সহজ ভঙ্গিতে সময় নিয়ে পাঠককে সাথে নিয়ে পথে নামেন। চলতে চলতে বলতে থাকেন রাজ্যের গল্প। টুকরো টুকরো সিন, মোমেন্টাম নিয়ে খেলা করেন। এই চলমান ভ্রমণে তিনি আমাদের অজান্তেই জায়গা করে নেন ভাবনার ড্রইংরুমে।

কিন্তু, সত্যজিৎ একটু ভিন্ন। মেটাফোর এর সহজিয়া কৌশল আর মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক পরিবারের চোখ দিয়ে দেখেন চারপাশ। দারিদ্র্য সেখানে থাকে। কখনো মনে হয়, এই গল্পতো আমাদের। কিন্তু, কখনো হয়তো দর্শক ভাবেই নি, সত্যজিৎ এই আপাতসরল গল্পে প্রতিবাদী হয়ে উঠছেন। বলছেন সময়ের সত্যনিষ্ট ইতিহাস। সত্যজিৎ ধীরে ধীরে সমাজের অবক্ষয়, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, স্বার্থ,প্রশাসনকে লক্ষ্য করে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেছেন ক্রমাগত। দেখিয়েছেন সমাজের নানা যা আজকের দিনের মানবিকতা ও মূল্যবোধের প্রশ্নে একান্তভাবে জরুরি ও প্রত্যাশিত।  সত্যজিৎ কীভাবে ভাবছেন, সেটা বুঝার জন্য তাঁর আরেকটি সাক্ষাৎকারের একটি অংশ তুলে ধরছি।

আপনি কি হীরক রাজার দেশে দেখেছেন? সেখানে একটি নির্মূল অভিযান আছে যাতে সব গরীব লোকজনকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানো হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর সময়কার জরুরি পরিস্থিতিতে দিল্লীতে এবং অন্য শহরগুলোতে যা ঘটেছিল, এ হলো তারই প্রত্য প্রতিফলন। এধরনের ফ্যান্টাসির ক্ষেত্রে আপনি পার পেয়ে আসতে পারেন। কিন্তু সমসাময়িক চরিত্র নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে, সেন্সরশিপের কারণে, আপনি কেবল একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত স্পষ্টভাবে বলতে পারেন। পষ্টভাবে বললে, আপনি মতাসীন দলকে আক্রমণ করতে পারবেন না। স্টোরি অফ এ চেয়ার-এর ক্ষেত্রে এটি বলার চেষ্টা করা হয়েছিল এবং পুরো ছবিকে নষ্ট করা হয়েছিল। এসব ক্ষেত্রে আপনি কী করতে পারেন? আপনি সমস্যাগুলো সম্পর্কে সচেতন আছেন, এবং আপনি সেগুলো নিয়ে কাজও করতে পারেন; কিন্তু আপনি আপনার সীমা সম্পর্কেও জানেন, যে প্রতিবন্ধকতার বাইরে আপনি যেতে পারছেন না।

সাউট অ্যান্ড সাউন্ড পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ রায় বলছেন,

‘আমার বিশ্বাস ব্যক্তিতে ও ব্যক্তিগত ধারণায় ন্যস্ত, সামগ্রিক চিন্তাধারা বা আদর্শ যা ক্রমশঃ পরিবর্তিত হয়, তাতে নয়।’

এইখানেই সুনীল সত্যজিতের দ্বৈরথের মূল বিষয়টি আরেকটু ভালো বুঝা যায়। সত্যজিৎ বলতে চেয়েছেন সবসময় ধ্রুব একটি অনুষঙ্গের কথা। মানুষের কথা। মানুষের অন্দরমহলের জানালায় দাঁড়িয়ে তিনি দেখেছেন কোলকাতা ট্রিলজির ‘প্রতিদ্বন্দ্বি’। তাই, আসুমদ্র হিমাচলের ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপট থেকে উত্তাপ পাওয়া সুনীলের  ‘প্রতিদ্বন্দ্বিকে’ কিছুটা আলাদা মনে হতেই পারে। এখানে বৈষয়িক তুলনার সুযোগ নেই। তাই দ্বৈরথের কথাও অবান্তর।

সত্যজিৎ যখন বলেন, চলচ্চিত্র সমাজ পরিবর্তন করতে পারে না, কখনো করেও নি। আপনি আমাকে একটি ছবি দেখান যার ফলে সমাজে পরিবর্তন এসেছে বা অন্য কোনো ধরনের পরিবর্তন এনেছে।  তখন আমরা অবাক হই। বুঝার চেষ্টা করি, তাহলে কেনো সমাজের কথা তুলে আনেন তিনি সেলুলয়েডে। কেনো পথের পাঁচালীর মতো কালজয়ী সিনেমায় ধরে রাখতে চেয়েছেন অন্য এক পৃথিবীর গল্প?

সুনীলের বয়ানে মেলে সে উত্তর। হ্যাঁ, আমি ফিরে আসব! আমি তো এখন ছদ্মবেশে আছি। শুধু কেয়ার কাছেই ফিরে যাব না, তার আগে, সব প্রতিশোধ নিতেও ফিরে যাব। ইন্টারভিউয়ের সেই লোকগুলো, চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলেছিল—আমি ওদের সবসুদ্ধু ধ্বংস করে দেব, ওই বাড়িটা পর্যন্ত ধুলোয় গুঁড়ো করে ফেলব, বাদল আর তার দুই সঙ্গী, ওরা আমার সারা মুখ রক্তে মাখামাখি করে দিয়েছিল। আমি যদি ওদের মুখ মাটিতে ঘষে না দিই…অনন্ত সান্যাল—ওর চোখ দুটো আমি উপড়ে নেব, চেনে না আমাকে, সেই পুলিশ অফিসারটা, এমনকী কেয়ার বাবাও যদি ঘুষখোর হয়—সব্বাইকে দেয়ালে দাঁড় করিয়ে দিয়ে রাইফেল হাতে নিয়ে…দেখে নিয়ো, ঠিক আমি ফিরে আসব!

ফিরে আসাটাই জীবনের সবচে বড়ো কথা। দুজনের বয়ানে ভিন্নতা আছে। আছে ইমাজেনিটিভ দ্বৈরথ। কিন্তু, একজায়গায় এসে ‘প্রতিদ্বন্দ্বি’র সিদ্ধার্থ, সুনীল ও সত্যজিৎ- উভয়ের দ্বৈত স্ট্রাকচারের ক্যানভাস হয়ে উঠে। ‘সবকিছুর শোধ তুলব একদিন! তুলবই! ’  উচ্চারণ করা সিদ্ধার্থ তখন ছাড়িয়ে যায় সময়কাল, অবস্থান। শিল্পীর প্রকাশ ও ভাবনা নিয়ে দ্বন্দ্ব চিরন্তন। তাদের কাজে মনোজাগতিক মঞ্চের ব্যাকগ্রাউন্ড ও ফোরগ্রাউন্ডে তৈরী হয় Stream of consciousness অথবা Adversary elements । কিংবা সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে তৈরী করা বৈচিত্র্যই এই দ্বন্দ্বের অনুঘটক। একইসাথে এখানেই শিল্পীর স্বার্থকতা। কিন্তু, যে উপন্যাস, যে চলচ্চিত্র মানুষের কথা বলে, মানুষকে আঘাত করে, ভাবায় সেই সৃষ্টি নিঃসন্দেহে স্বার্থক। অভিযোজন এখানে কেবল ন্যারাটিভ ও স্ট্র্যাকচারের ট্রান্সফর্মেশন। অন্যভাবে বলা যায়, Adaption বা অভিযোজন একটি বাহন বা Way of Storytelling ।

 আমাদের মনোস্তাত্বিক পরিমন্ডলে সত্যজিতের  মতো আদিগন্ত বহমান শান্ত নদী যেমন প্রয়োজন। তেমনই সুনীলের মতো জীবনঘনিষ্ঠ স্টোরিটেলারও সাদরে আমন্ত্রিত। সীমাবদ্ধ অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে সত্যজিৎ কিংবা সুনীলের মতো কাউকে বুঝতে যাওয়া অনাবশ্যক। একইসাথে প্রশ্নতোলার অধিকারও শতভাগ পাঠক ও দর্শকের।

জীবনকে তার স্বমহিমায় আবিষ্কারের অনিঃশেষ যাত্রার শেষ না হোক।


(এই লেখাটি একটি একাডেমিক এসাইমেন্টের খন্ডিত অংশ। পূর্বের অংশে বই/রচনা থেকে সিনেমা নির্মাণ বা অভিযোজন বা এডাপশন ও সত্যজিৎ-সুনীলের প্রতিদ্বন্দ্বি নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে। আমার এই ভিন্ন বয়ানের অনেক বড়ো একটা প্রেরণা এসেছে বিধান রিবেরুর সত্যজিতের রাজনৈতিক ট্রিলজি নামক বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত একটি আর্টিলকেল থেকে। মূল রচনাটি এখান থেকে দেখে নিতে পারেন।)

তথ্যসূত্রঃ

– রায়, সত্যজিত। (১৯৮২)। বিষয় চলচিত্র। কোলকতা; আনন্দ পাবলিশার্স।
– রায়,সত্যজিত। (১৯৬৩)। চলচিত্রের সংলাপ প্রসঙ্গে।শারদীয় সংখ্যা, আনন্দবাজার পত্রিকা।
– বিনোদন রিপোর্ট। (৯২০১৭,২৩ এপ্রিল)। চিত্রনাট্য-বিষয়ে-সত্যজিত-রায়ের-ভাবনা।
– ‘বামপন্থী কিনা জানি না তবে প্রগতিশীল ছিলেন’, জ্যোতি বসুর নেয়া পরিমল ভট্টাচার্যের সাক্ষাৎকার, ঋতুপর্ণ ঘোষ সম্পাদিত ‘আনন্দলোক’, ২ মে ১৯৯৮। আনন্দলোকের এই বিশেষ সংখ্যার নাম রাখা হয় ‘মানিকবাবু’।
– John W. Hood, Beyond the world of Apu: the films of Satyajit Ray, Orient Longman, 2008, New Delhi.
– শুভেন্দু দাশগুপ্ত, সত্যজিৎ রায়: নিজের কথায়, শীতলচন্দ্র ঘোষ ও অরুণকুমার রায় সম্পাদিত ‘সত্যজিৎ রায়: ভিন্ন চোখে’, ভারতী বুক স্টল, ২০০২, কলকাতা।
– নিজের আয়নায় সত্যজিৎ: দীর্ঘতম ও শেষ সাক্ষাৎকার, বদ্বীপ, ২০১২, কলকাতা।
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রতিদ্বন্দ্বী, দে’জ পাবলিশিং, ২০০২, কলকাতা।

Leave a Comment