Hafizul Islam

একটি বিচ্ছিন্ন বিকালের অনর্থক বয়ান – জার্ণি টু জাবি সিরিজ – ১

পড়েছেন: 1,002 জন পাঠক

প্রথম দৃশ্য

পাবলিক পরিবহণের বিশেষ এক শ্রেণীতে করে জাহাঙ্গীরনগর থেকে  ঢাকায় ফিরছি। আমার সামনের দুই সারি আসনে খুব গল্প করছেন কয়েকজন বন্ধু। নিছক আড্ডা বলা যেতে পারে। আমার নিজেরও বাস জার্ণির এই দৈনিকের সময়ে গল্পচারিতা ভালো লাগে। আজকে চুপচাপ বই পড়তে পড়তে সময় কাটাচ্ছি। সামনের ওদের হাসি আর শব্দে বই পড়তে ভালো না লাগলেও বিরক্তি লাগছিলো না।

এই বিভ্রান্ত সময়ে বন্ধুদের নির্মল আড্ডা কিংবা খুনসুটির আন্তরিক সুর বেশ স্বস্তির। গতকাল চার বছরেরও কম বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যার খবর আমার মানসিক শান্তিকে যথেষ্ট রকমের আঘাত দিয়েছে। তাই, একরকম নিজের আপন জগতে ডুবে থেকে শান্তির তালাশে  আছি আমি। গাড়ির একটানা শব্দ আর বাইরের হু হু বাতাস আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিলো, আমি আছি এবং চলছি। ওদের টুকটাক গল্প-শব্দ কানে ভেসে আসছে।

সামনের আড্ডার কিছু বাক্য এবং শারীরিক আচরণ আমার কানে বেখাপ্পা লাগলো হঠাৎ। মনে হচ্ছিলো, এই সহজ আড্ডাটা আসলে যতোটা স্বাভাবিক ও সুন্দর ভাবছিলাম, হয়তো তেমন নয়। এক ছেলে বন্ধু তার মেয়ে বন্ধুকে বাক্যবানে আঘাত করে কিছু বলে যাচ্ছে। সামনের মেয়ে বন্ধু দুটি কথাগুলো এড়িয়ে যাওয়া জন্য ব্যস্ততার ছলে কানে হেডফোন দিয়ে গান শোনার চেষ্টা করছে। কিছুটা বিরক্তিসহকারে মনোযোগ দিলাম ওদের সংলাপে।

আরে পরমা (ছদ্মনাম), তুমি জেলাস ফিল করছো কেনো! রাজা থাকতে তুমি সিপাহী দিয়ে কাজ চালাও! আমি আছি না তোমার জন্য! মেয়ে হয়ে একটা মেয়ের প্রতি আগ্রহ থাকাটা কি ঠিক, বলো! তুমি জানো না, আঙুরফল হয় হট! আরে! ওকে চিমটি না দিয়ে আমাকে দাও। তোমার হাতের ছোঁয়ায় আমার শরীরে ফিল আসে!

আমাদের গাড়ি তখন হেমায়েতপুর পাড় হচ্ছে। মেয়েদুটো কখনো এক্সাম কখনো বাসার কথা বলে বলে আড্ডার মোড় ঘুরিয়ে দিতে চাইলেও ছেলেগুলো তাদের অদ্ভূত এবং বিচ্ছিরি ভাষার ব্যবহার চালিয়েই যাচ্ছিলো। গাবতলী পার হবার পথে জাতীয় বীজ পরীক্ষা কেন্দ্র (নামের শব্দে তারতম্য থাকতে পারে) নামের একটা সরকারী প্রতিষ্ঠান আছে। সেটা দেখিয়ে এক ছেলে আরেক ছেলেকে বলছিলো, চল আমরা আমাদের বীজ পরীক্ষা করিয়ে আসি। মেয়েদেরও ইঙ্গিতে সাইনবোর্ড দেখিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছিলো!

আমি বিরক্তি লজ্জা রাগ এবং ঘৃণায় হতবাক হয়ে ভাবছিলাম, আহ! নির্মল বিনোদন কিংবা আড্ডার দিন মনে হয় শেষ হয়ে যাচ্ছে। ছেলে দু’টোকে ভালো করে খেয়াল করলাম। আমার বয়সী-ই হবে। চমৎকার পোশাক-আশাক। বেশ পরিপাটি সাজগোজ। হ্যান্ডসাম। এই বয়সেই কাজী নজরুল ইসলাম যুদ্ধে গিয়েছিলেন। লিখেছেন অসংখ্য জ্বালাময়ী গান-কবিতা। সুকান্ত ভট্টাচার্য বিদ্রোহ করেছিলেন কী দারুন সাহস নিয়ে। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ভেবে গেছেন দেশের স্বাধীনতা নিয়ে।

আর,  কী করছে  এই ছেলেগুলো! কী করছি আমরা! যেখানে হাজারো বই তাকের পর তাকে পড়ে ধুঁকছে ধুলোর সাথে। শিক্ষক প্রাণপন চেষ্টায় আলো ছড়াতে চাইছেন শিক্ষার্থীদের মাঝে। মেধাবী সাহসী নির্মাতারা মুভির মধ্য দিয়ে ভাবা শেখাতে চাইছেন আমাদের, সেখানে আমরা কোথায় যাচ্ছি দিনের পর দিন!

দ্বিতীয় দৃশ্য

টেকনিক্যাল মোড়। রাস্তার সংস্কার কাজ চলছে। আমার সামনের স্টুপিডদের থেকে মনোযোগ সরিয়ে আমি দেখছি আমার চারপাশ। একা থাকলে বরাবর যা করি। আইল্যান্ডের কোল ঘেষে বাস দাঁড়িয়ে আছে সাময়িক সিগন্যাল জ্যামে। পাশেই কিছু ইটের স্তুপে বসে ঠুকঠাক শব্দে ইট ভাঙছেন একজন শ্রমিক। দেখতে দেখতে হঠাৎই খেয়াল করলাম, তার একটি পা নেই! এই অঙ্গহীনতা তাকে দমিয়ে রাখতে পারে নি! অন্যান্য শতভাগ সক্ষম  সঙ্গীদের সাথে তাল মিলিয়ে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন এক মনে।

তখন বিকালের আলো নেমে যাচ্ছে শহরের অনিয়ন্ত্রিত দালানকোঠায় ঢাকে ফেলা দিগন্তের ওপারে। দুই লেনের রাস্তার এক লেনে বসে আছে আমাদের বাস। অন্য লেনে ইটভাঙা শ্রমিকদের কাছঘেষে সাঁই সাঁই ছুটে যাচ্ছে যানবাহন। এসবের কোন কিছুই এক পায়ের মালিক, সেই শ্রমিকের মনোযোগ নষ্ট করছে না। তিনি হাতুড়ির একেকটি আঘাতে ভেঙে চলেছেন ময়লাধরা পুরনো ইট। যেনো তার অগণিত অধরা স্বপ্নের আক্ষেপ, সমাজের প্রতি-দরিদ্রতার প্রতি বিরক্তি আর জেদ, শক্তি হয়ে আছড়ে পড়ছে ইটের সুড়কিতে। বাতাসে উড়ছে কেমিকেল মেশানো নোংরা ধুলো আর ধুয়ার মেঘ। একটা সিগারেটের প্যাকেট আছে হাতের কাছে। যেই প্যাকেট থেকে সরকারকে ট্যাক্স দিচ্ছেন তিনি। সেই ট্যাক্সের টাকার একটা অংশ আছে আমার পাবলিক ভার্সিটি ফান্ডে। যে টাকায় আমার কম খরচে পড়াশোনার সুযোগ হচ্ছে।

 

শেষদৃশ্য ও উপসংহার

প্রথম দৃশ্যের বন্ধুরা সবাই যার যার সুবিধামতো নেমে যাচ্ছিলো। মেয়েগুলো বলছিলো, ভালো থাকিস রে তোরা। আর, এমন বদ হইস না। ভালো হ। ছেলেগুলো হা হা করে হাসতে হাসতে বলছিলো, আমার দেখা হবে জান। ভালো থেকো। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করো। স্বাস্থ্য ঠিক রেখো। ইঙ্গিতে বলে দিচ্ছিলো স্বাস্থ্য খারাপ হলে তাদেরই লস!

আর আমার মাথায় চলছিলো অন্য সিনেমা। যেখানে একজন এক পায়ের পরিশ্রমী শ্রমিক আমার পড়াশোনার খরচ কমানোর জন্য তার কষ্টের টাকার একটা অংশ ট্যাক্স হিসেবে দিচ্ছেন। জানি আমি, তিনি এতো মহৎ কিংবা বিশাল অর্থে চিন্তা করে কাজটি করছেন না। তবুও তিনি করছেন আমাদের জন্য। এই বাসে দিনের পর দিন আমার মতো অসংখ্য শিক্ষার্থী বিনা ভাড়ায় চড়ছেন। সামনের সারির বন্ধু নামের রাবিশ ছেলেগুলো কিংবা বুঝতে অপারগ মেয়েগুলোর সবার পড়াশোনার পেছনে এই এক পায়ের মানুষটির অবদান আছে।

তার মতো বাংলাদেশের আমজনতার ট্যাক্সের টাকায় সারাদেশে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত সংসারের সন্তানরা পড়াশোনা করে যাচ্ছে। ভার্সিটির বাসে বিনা পয়সায় যাতায়াত করছে। কখনো কখনো পাবলিক বাসে আইডি কার্ড দেখিয়ে অর্ধেক ভাড়ার সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে।  এই যে এতো এতো সুযোগ আমরা পাচ্ছি, এতো এতো সুবিধা আমরা নিচ্ছি, বিনিময়ে কী হচ্ছি আমরা!

যে ছেলেটি তার মেয়ে বন্ধুটির সাথে জ্ঞাতসারে এই ধরণের অন্যায় ও অনায্য অশ্লীল আচরণ করছে, সেকি আসলে বন্ধুকে সম্মান করতে পারছে? আমি বলছি না, শিক্ষার্থীরা সবাই শিক্ষার পরিবর্তে শিক্ষিত না হয়ে এমন অদ্ভূত চরিত্রে রূপ নিচ্ছে। কিংবা, আমাদের সবকিছুই রসাতলে যাচ্ছে। ভালোর পরিমাণ কমছে আশঙ্কাজনক হারে, ভাবনার বিষয় সেটাই। সারাদেশে সবখানেই এমন চিত্র দেখা যাবে। আমাদের চারপাশের সমাজজুড়েই এমন আচরণ/আড্ডার/কনটেন্টের এই দুষিতায়নের দেখা মেলে আজকাল।

ছেলেগুলোর আচরণ ঠিক-বেঠিক, উচিত-অনুচিত, শ্লীল-অশ্লীল এইসব বিচারের অধিকার অথবা দায় কোনটাই আমার নেই। আমার কাছে যেটা দৃষ্টিকটু কিংবা অন্যায়, সেটা অন্য কনটেক্সে অন্যদের কাছে সঠিক কিংবা নায্য হতেই পারে। আমি এখানে শুধু আমি আমার পারসেপশন/দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছি ও তার ভিত্তিতেই লিখছি।

আমাদের সিস্টেমের মাপকাঠিতে মেধাবী কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীর এই ধরণের ব্যবহার আমার ভেতরের মন খারাপকে যেমন বাড়িয়ে দেয়। একই সাথে সেই ইট ভাঙতে থাকা পরিশ্রমী হাতের প্রত্যয়ী ও দায়িত্বশীল মানুষটির, প্রতিটি হাতুড়ির আঘাত আমাকে আশান্বিতও করে।

আমি একজন বিচ্ছিন্ন মানুষ কোন এক বিচ্ছিন্ন বিকেলের দুটি পৃথক দৃশ্যপটকে একসাথে জোড়া দেয়ার চেষ্টা করি। এই জোড়া দেয়া কিংবা ঘটনার বয়ান সত্যিকার অর্থে কোন উপকার বয়ে আনবে না হয়তো। কিন্তু, নিজের কাছে নিজে এই অনর্থক বয়ানের মধ্য দিয়ে বার্তা দিতে থাকি যে, আমার/আমাদের অনেক দূরের পথ পাড়ি দিতে হবে। যেতে হবে বহুদূর, ঘুমিয়ে পড়ার আগে..।

 


জার্ণি টু জাবি সিরিজ নামের এই  ধারাবাহিক প্রকাশনাটি আমার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতের সময়কালের ডায়েরী হিসেবে লিখছি। যাত্রার ক্ষেত্রে কখনো আমি পাবলিক বাস আবার কখনো বিশ্ববিদ্যায়ের বাস ব্যবহার করি। চলতি পথের নানা ঘটনা আর ভাবনা নিয়ে এই সিরিজ। এই লেখাগুলোতে কখনো কাউকে উদ্দেশ্য করে কিংবা কোন শ্রেণীকে আঘাত অথবা হেয় প্রতিপন্ন করা কিংবা অসম্মান করে কিছু বলা হয় না। বরং  একান্ত নিজস্ব পারসেপশন/দৃষ্টিভঙ্গি/ধারণা প্রকাশ করা হয়। যদি এর কোন লেখা কাউকে আঘাত দেয়, সেটা তার নিজস্ব কল্পনা বা ভাবনা বা দৃষ্টিভঙ্গি। লেখকের কোন দায় নেই তাতে। ধন্যবাদ!

Leave a Comment