Hafizul Islam

সেদিন বিকালে এ্যাক্সিডেন্টের ঠিক আগমুহুর্তে আমি যা ভাবছিলাম

পড়েছেন: 267 জন পাঠক

রাজধানীর কাফরুলে শনিবার বিকালে এক সড়ক দূর্ঘটনায় অজ্ঞাতনামা যুবক আহত। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাস্তার মোড় ঘুরতে গিয়ে একটি স্কুটার ফুটপাতে উঠে সেই যুবককে ধাক্কা দেয়। স্কুটারের চালক ও তার সহযাত্রী প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে সুস্থ হলেও যুবকের অবস্থা শংকাজনক।

এমন একটি সংবাদ আইটেম হতে হতেও বেঁচে গেছি আমি। কারণ, স্কুটারটা শেষ পর্যন্ত আমাকে খুবই কাছ দিয়ে পাশ কাটিয়ে দুরন্ত গতিতে ফুটপাতের প্রান্তে থাকা টিনের বেড়াতে আঘাত করে। আমি তখন রাস্তার মোড়ে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বাসার গ্যাস বিলের কার্ড রিফিল করতে বাইরে গিয়েছিলাম। রাস্তার মোড় পার হচ্ছি। এমন সময় আমি দেখছিলাম, সাঁই সাঁই গতিতে একটি স্কুটার সোজা আমার দিকে উড়ে আসছে। চালকের হাতে কোন ব্যালেন্স নেই। উনি আমার দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছেন। আমি উনার চোখের তীব্র ভয় ও বিহ্বলতা দেখতে পারছিলাম। আমার ডানপাশের রোড আটকে তখন একটি সাদা রংয়ের টয়োটা করোলা দাঁড়িয়ে। কোনদিকে সরে যাওয়ার মতো অবস্থা নেই। আমি তাই স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে আছি। আমার মনে হচ্ছিলো, অনন্তকাল ধরে আমি অপেক্ষায় আছি একটি চমৎকার এ্যাক্সিডেন্টের।

মুহুর্তটা খুবই সংক্ষিপ্ত হলেও আমার চিন্তায় এর পরিধি অনেক বিস্তারিত হয়েছিলো। কতোকিছু ভাবনায় চলে এসেছে। প্রথমেই মাথায় আসছিলো, কী পরিমাণ ব্যথা লাগবে আমার। তারপর ভেবেছি, যে কয়টা টাকা আছে, সেটা দিয়ে হাসপাতালের খরচ মিটবে তো। মোবাইল রেখে গিয়েছিলাম বাসায়। কীভাবে কাউকে খবর দিবো, চিন্তা হচ্ছিলো। পকেটে কোন মানিব্যাগ নিয়ে বের হই নি। আইডি কার্ড, পরিচয়ের মতো কোন কিছুই সাথে ছিলো না। তাই, কেউ প্রাথমিকভাবে আমার পরিচয় না জেনেই হয়তো হাসপাতালে নিয়ে যাবে। আমাকে কি আদৌ কোন হাসপাতালে ভর্তি নিবে? এমন নানান কিছু ভাবনায় এসে হাজির হয়েছিলো মুহুর্তেই।

আমি তখনও যেনো জানতাম, এই এ্যাক্সিডেন্টে আমি মরবো না হয়তো। কিন্তু, ভোগান্তির অন্ত থাকবে না। তাই, এই অন্তিম মুহুর্তে সংকীর্ণ গলির মুখে দাঁড়িয়েও আমার ভয় হচ্ছিলো। মৃত্যু আমার কাছে খুবই স্বাভাবিক একটি অনুষঙ্গ। ছোটবেলা থেকে অসংখ্য মৃত্যু খুব কাছে থেকে দেখেছি। প্রিয়জনদের নিজ হাতে কাফন পড়িয়ে নামিয়েছি কবরে। কষ্টের অনুভূতিগুলোও সামলে নিতে নিতে জেনে গিয়েছি বহু আগেই, মৃত্যু আমাদের জন্মের চেয়ে অনেক বেশি অবধারিত বাস্তব। মৃত্যুকে আমার তাই কেবল একটি সাময়িক পোর্টাল বা ট্রান্সফার ক্যাপসুল বলে মনে হয়। একটি ডাইমেনশন থেকে অন্য ডাইমেনশনে যাবার একটি টানেল। মৃত্যুর চেয়ে আমি ভোগান্তিকেই অনেক বেশি ভয় করি।

শৈশবে যখন প্রথম শহর ছেড়ে গ্রামে যাই, তখন আমাদের পাশের বাড়িতে এক বৃদ্ধা থাকতেন। একা। আমরা ছোটরা তাকে মধু বুড়ি বলে ডাকতাম। বয়সের ভাড়ে তার চামড়ার ভাঁজগুলো এতো বেশি প্রকট ছিলো যে, তার একসময়কার ভাঁজহীন চেহারা কল্পনাও করতে পারতাম না। তিনি বার্ধক্যের কারণে প্রায় অসুস্থ থাকতেন। দেখাশোনার কেউ ছিলো না বলে আশেপাশের বাড়ি থেকে আমাদের মায়েরা কিংবা চাচীরা সুযোগ করে তার খোঁজ নিতেন। মাঝে মধ্যে তিনি এমন অসুস্থ হয়ে পড়তেন যে, বাথরুমে না যেতে পেরে বিছানা নোংরা করে ফেলতেন। এই নোংরা বিছানাতেই দিন কাটিয়ে দিতে হতো তাকে। পরে কেউ হয়তো এসে তাকে পরিষ্কারের দায়িত্ব নিতো। আমার চোখের সামনেই আমি তাকে মরে যেতে দেখেছি ভোগান্তিতে। সেই থেকে যেকোন রকমে ভোগান্তিকে আমি ভয় পাই। ভীষন ভয়। তাই, এ্যাক্সিডেন্টের আগমুহুর্তে আমি সেরকম ভয়ই পাচ্ছিলাম।

চোখের সামনে ফিল্মের ফ্ল্যাশব্যাকের মতো কিছু দৃশ্য মেমোরি থেকে ঝিঁকিয়ে উঠছিলো।  শৈশবের আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিস কলোনির গেটের বাইরের রাজপথ ছিলো আমার দেখা প্রথম কোন রাজপথ। এতো গাড়ি আর রিকশা আমার কাছে অবাক করার মতো ছিলো। কাফরুলের মোড়ের সেদিনের রাস্তাকে আগ্রাবাদ কলোনির মেইন রোড বলে মনে হচ্ছিলো। যেনো একটু পরেই সেন্ট্রি আংকেল পেছন থেকে ধমকে উঠবেন। বলবেন, এই ছেলে! তুমি কোন বাসায় থাকো? রাস্তায় যাওয়া নিষেধ, তুমি জানো না? তোমার বাবার নাম কী? কলোনির নিত্যদিনের খেলার সাথী আইরিন তখন আমাকে টেনে নিয়ে আবার ফিরবে পিটি মাঠে। এইসব স্মৃতি যেনো আমার গতজন্মের। ভাবছিলাম, নেটফ্লিক্সের অর্ধেক দেখা সিরিয়লটির শেষ পরিণতি কী হবে, জানা হলো না। ঢাকার বাইরে আমার আর অন্তরার একটা একদিনের ট্রিপ দেয়ার কথা ছিলো, সেটাও হলো না। এশা, তাসফিয়া, হান্নাদের সাথে ইউনিভার্সিটির বাসে আর যাওয়ার সময় হয়তো হবে না। কম্পিউটার টেবিলে থাকা ছোট্ট সবুজ গাছটিতে আজকে পানি দেয়ার কথা মনে ছিলো না। আমার অনুপস্থিতিতে গাছটি কি বেঁচে থাকতে পারবে?

মৃত্যুকে নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে মানুষ কীরকমভাবে চিন্তা করে, সেটা আমার জানা নেই। হয়তো সেও এমন করেই জীবনের ক্ষুদ্র ও সাধারণ নানান ঘটনাকে নিজের সামনে দেখতে পায়। কে জানে…। কিছুদিন ধরে একটা সুন্দর কাঠের টেবিল বানানোর পরিকল্পনা করছিলাম। সেই টেবিলটাও বানানো হবে না, এই চিন্তা আমার তখন মনে হচ্ছিলো। প্রিয় মানুষদের চেয়ে খুব সাধারণ কিছুর কথা আমার বেশি মনে পড়ছিলো। যিনি স্কুটার চালাচ্ছিলেন, তার চোখের ভয়ার্ত দৃষ্টিকে আমার শিকার হওয়ার অন্তিম মুহুর্তে বাঘের সামনে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকা হরিণের চোখ মনে হচ্ছিলো।

ক্যারামেল কালারের স্কুটারের পেছনের সিট থেকে তখন বিচ্ছিরি কন্ঠে স্কুটার চালক স্ত্রীকে তিরস্কার করছিলেন পৌরুষ দেখানো স্বামীপ্রবর। স্ত্রী কতোটা আহত হতে পারে, সেটার চেয়ে তিনি স্কুটারের স্বাস্থ্যচিন্তায় বেশি কাতর হয়ে পড়ছিলেন। স্বামীর সেই কাতরতা দেখে আমার করুণা হচ্ছিলো বেচারার প্রতি। স্কুটার চালকের জন্য মায়া লাগছিলো। এ্যাক্সিডেন্টের পর স্ত্রীর পরিবর্তে আগে স্কুটারকে নিয়ে ব্যস্ত হতে দেখে আমি বিরক্ত হলেও অবাক হই নি। এই সমাজ আমাদেরকে কখেনোও আসলে সত্যিকারের মানুষ হতেই শেখায় নি। আমরা পুরুষ হয়ে জন্মাই। আমরা কর্তৃত্বপরায়ণতা উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করি। তাই, স্ত্রীর বদলে স্কুটারকে আগে বাঁচাবেন স্বামীপ্রবর, এটাকেই স্বাভাবিক লাগে।

ময়লাটে ট্রাউজার, ফ্রিতে পাওয়া প্রমোশনাল টিশার্ট পরে হাতের মুঠোতে কিছু টাকা নিয়ে আমি অনন্তকাল ধরে দেখছিলাম এইসব দৃশ্য। ভাদ্রের একটি বিকালে কাফরুলের কোন এক তেরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে অজ্ঞাতনামা এক যুবক। অপেক্ষায় আছে কখন আসবে ক্যারামেল কালারের সেই দ্রুতধাবমান স্কুটার। কী ভীষণ অবাস্তব এক একটি মুহুর্ত! আজকে লিখতে বসে ভাবছি, যদি সেদিন সত্যিই আমার মারাত্মক এ্যাক্সিডেন্টটি হয়ে যেতো, তাহলে হয়তো এই লেখার সুযোগটি পেতাম না। নতুন করে আরো অনেকগুলো মুহুর্ত বেঁচে থাকার এই সুযোগটি কি আসলেই মঙ্গলের? আমার কি আসলেই প্রয়োজন আছে খুবই কিঞ্চিতকর এই জীবনকে আরো সামনে টেনে নিয়ে যাবার?

মানুষ হয়ে জন্মানোর সবচে বড় দুর্বলতা হয়তো, শত ব্যর্থতার পরেও বেঁচে থাকার আকাঙক্ষা কখনো না ফুরনো। হয়তো সেকারণেই দূর্ঘটনাটি শেষ পর্যন্ত ঘটে নি বলে আমি খুশিই হয়েছি। বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে পিসিতে শেষ না হওয়া সিরিয়ালটি দেখতে শুরু করেছি। একটা সময় আমার মাথা থেকে এরকম থমকে যাওয়া শরতের বিকালটির তাজা স্মৃতিগুলো ফিকে হয়ে যাবে। তাই, এই ডিজিটাল ডায়েরিতে লিখে রাখলাম , এ্যাক্সিডেন্টের ঠিক আগমুহুর্তে আমি কী ভাবছিলাম..। হয়তো কখনো লেখাটি পড়তে গিয়ে মনে পড়বে, টিকে থাকাটাই মানুষের শেষ গন্তব্য।

Leave a Comment