Hafizul Islam

littleness কিংবা ক্ষুদ্রতা শব্দটির সাথে আমার পরিচয় যেভাবে

পড়েছেন: 113 জন পাঠক

ক্ষুদ্র শব্দটির সাথে আমার সত্যিকারের পরিচয় হয় ২০০০ সালের কোন এক ভরদুপুরে। সেদিন বাস অ্যাক্সিডেন্টে আমার সবচে প্রিয়জন, বড় মামার মৃত্যু হয়। লাশকাটা ঘর আমি সেদিনই প্রথম দেখি। মামার মৃত্যুর খবর আমাদের পরিবারের জন্য অনেক বড় একটি আঘাত হিসেবে এসেছিলো। সেই সময়ের ক্ষত এখনো কাটে নি বলেই আমার মনে হয়। নারায়নগঞ্জ সরকারি মর্গের লাশকাটা ঘরের ফ্লোরে সারি করে ৬/৭ টি মানুষ পড়েছিলো, রক্তাক্ত। পরনের পোশাক অ্যাক্সিডেন্টের কারণে শতচ্ছিন্ন। বাইরে স্বজনদের আহাজারির শব্দ ক্রমাগত ঢেউয়ের মতো ভেসে বেড়াচ্ছিলো। বাবার চাকরির সুবাদে বিশেষ অনুমতি পেয়ে আমরা ঢুকতে পেরেছিলাম মর্গে।

লাশকাটা দেখার ভয়ংকর অভিজ্ঞতা আমার সেদিনই প্রথম হয়। একটি শিশুর লাশের ছবি আমার মাথায় চিরদিনের মতো আটকে আছে। অগুণিত মাছির ভনভন শব্দ আর শিশুটির নানার অবিশ্রান্ত বিলাপের আচ্ছাদনে পরেছিলো শিশুটির ছিন্ন লাশ। এই দৃশ্যটি আমি এতো বছর পরেও স্পষ্টভাবে মনে করতে পারি।

মামার মৃত্যু ও পরবর্তী কিছুদিন আমি কোন মোটরযানে উঠতে পারতাম না। ভয় পেতাম। আমাদের সব আত্মীয়দের মনে হয়েছিলো, তাদের জীবন এখানে থমকে যাবে। কিন্তু, স্বাভাবিকভাবেই সেটা হয় নি। আমরা আমাদের জীবন নিয়ে নিজেদের মতো করে সামনে এগিয়েছি। প্রতিবছর মামার মৃত্যুবার্ষিকী ছাড়া আমাদের হয়তো তার কথা মনেও পড়ে না। আমাদের সবকিছু জুড়ে তিনি উপস্থিত ছিলেন। সিজনের প্রথম আম, কাঠাল, তরমুজ কিংবা কোরবাণীর গোশত নিয়ে উনি আমাদের বাসায় আসতেন। মুখভর্তি সাদাকালো দাঁড়ি আর উজ্জ্বল হাসি নিয়ে মামা এসে দাঁড়াতেন আমাদের দরজায়। কিংবা কখনো রিকশায় পাশাপাশি পার হয়ে গেলে দূর থেকে শব্দ করে সালাম দিতেন। আমার শৈশবের চমৎকার স্মৃতিগুলোর অনেকাংশ জুড়েই আছে বড়মামা, আজিজ মোল্লা। মামার মৃত্যুর সময়কার সবকিছু এখন ক্ষুদ্র, নগন্য। আমার বাসার সামনের তরকারি বিক্রির ফেরিওয়ালা কিংবা বারান্দায় রাখা ফুলগাছে পানি দেয়ার বিষয়গুলোও মামার নেই হয়ে যাওয়ার চেয়ে বেশি জরুরী মনে হয়।

শৈশব কৈশোর পার হতে হতে এমন অসংখ্য বিষয়, ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। যেসব একসময় খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো। কিন্তু, সময়ের সাথে সাথে সেগুলো এখন আর আগের মতো প্রয়োজনীয় কিংবা জরুরী মনে হয় না। গৌণতা এসে দখল করে নেয় একসময়ের বৃহৎকে। কী অদ্ভূত! নিজের চারপাশে পথ চলতে চলতে অনেক শুভনুধ্যায়ী, বন্ধু কিংবা সহযাত্রীর দেখা পেয়েছি। তাদের ছাড়া চলা অসম্ভব বলেও মনে হতো কখনো। কিন্তু, সময়ের পরিক্রমায় তারা ছিটকে গেছে খসে যাওয়া তারাদের মতো। অসংখ্য অগণিত প্রিয়মুখ ফিঁকে হয়ে গেছে স্মৃতি থেকে। তারা এখন কোথায় আছে, আদৌ আছে কিনা কোথাও, সেসব নিয়ে কোন চিন্তা কিংবা ভাবনার অবসর আমার নেই। চলমান সময়ের মাঝে তারা আর থই পায় নি। এই ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটতে থাকছে। বৃহৎ অবস্থান জুড়ে থাকা মানুষ, স্মৃতি ক্ষুদ্রতার খামে গিয়ে ঢুকছে। পরিবর্তিত সময় কিংবা প্রয়োজনের কাছে তাদের ক্ষুদ্র হতেই হচ্ছে।

তাহলে মানুষের গর্ব করার মতো বৃহতের ধারণা কেনো আসে? কেনোইবা মানুষ তার বেঁচে থাকাকে প্রতিদিন গ্লোরিফাই করার চেষ্টা করে? এর উত্তর আমার জানা নেই। এই বিশাল বৃহ্মান্ডে সূর্যকে ঘিরে আমাদের যে জগত, সেটার পরিধি অনেক ছোট। সেই পরিধিতে আমাদের এই সবুজ গ্রহটি ততোধিক ক্ষুদ্র। আর এই গ্রহের ছোট একটি দেশের একটি শহরের ছোট একটি গলির কবুতরের খোপের মতো বাসায় থাকা আমার কোন অস্তিত্বকে আলাদা করে বলার মতো কিছু আছে, এটাই কখনো আমার মনে হয় নি।

আমি ছোটবেলা থেকেই গ্যালারীতে বসে থাকা লোক। চারপাশের শতমুখী ব্যস্ততা আমার কখনো সহজ মনে হয় না। তাই আমি মানুষ দেখি। নিত্যদিনের আড্ডার আসর, চায়ের টেবিল কিংবা সাধারণ গল্পে আমি অরিজিনাল মানুষ দেখি না। আমরা সবসময় কেমন যেনো অদ্ভূত সব ভারী আর সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা বলি। মঙ্গলে পানি পাওয়ার সম্ভাবনা, স্যোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রাম্পের হুতুমমার্কা উপস্থিতি, ভাইরাল ভিডিও, ভিভিআইপি মুভমেন্ট নিয়ে শহরভর্তি মানুষের জ্যাম, অনন্ত জলিলের মুভির সিজি/কম্পিউটার গ্রাফিক্স কেমন ইত্যাদি নিয়েই আমাদের সময় কাটে!

অথচ, আমার ঠিক পাশের বন্ধুটির চোখের নীচে নির্ঘুম রাতের কালো দাগ আমার নজর এড়িয়ে যায়। প্রতিদিন একসাথে বসবাস করা প্রিয়জন গভীর দুঃখ নিয়ে সারারাত ছটফট করতে থাকে। আমাদের কখনো সেদিকে মনোযোগ পড়ে না।  সদ্য বিবাহিত মেয়েবন্ধু তার নতুন জীবনে আসলে কেমন কাটাচ্ছে, সেকথা জানতে চাওয়ার ফুসরৎ আমাদের নেই! কিংবা, টিউশনীর টাকায় টিকে থাকা সহপাঠীর করোনাকালের ইনকামহীন মুহুর্ত কীভাবে কাটছে, সেসব দেখার আগ্রহ আমাদের হয়ে উঠে না!! কারণ, এগুলো ব্যক্তি আমার চেয়ে ক্ষুদ্র!

প্রতিদিন আমি আমার ব্যক্তিগত ক্ষুদ্রতাকে নানা মাত্রায় আবিস্কার করি। নিজের ক্ষুদ্রতা আমাকে লজ্জা দেয়। বিনয়ী হতে বলে। কিন্তু, সত্যিকার অর্থে আমি কি আসলে বিনয়ী হই? সম্ভবত না। মানুষ হওয়ার অন্যতম অপরিক্কতা হচ্ছে, নিজের অস্তিত্বকে বড় ভাবার প্রবণতা নিয়ে জন্মানো। সেই প্রবণতা এড়িয়ে মানুষকে শ্রদ্ধা করা কিংবা নিজেকে সবসময় ডাউন-টু-আর্থ রাখা বেশ জটিল বিষয়। তবুও, আমি ভাবতে চাই যে, আমি অন্তত চেষ্টা করছি। আমার টিকে থাকার ছোট্ট মুহুর্তটিই শুধুমাত্র সত্যি। আর কিছু নেই। আমি কেউ না। সময়ের সবিস্তার ক্যানভাসে প্রায় শূন্য পিক্সেলের একটা ডট মাত্র।

আমার নিত্যকার দুঃখ-চাহিদা,অপরিপূর্ণতা-অভাববোধ, বেদনা, সবকিছুই আসলে খুবই ইনসিগনিফিকেন্ট। এসব নিয়ে ক্লান্ত হওয়ার কিছু নেই। চারপাশের সবাই ছুটছে ধাবমান বেগে। পড়াশোনা, রেজাল্ট, ক্যারিয়ার, সংসার ইত্যাদির আউটলাইন তৈরী করতে গিয়ে নাকেমুখে রক্ত তুলে খেটে যাচ্ছে সবাই। সফলতা নাম দিয়ে আমরা কেবলই ছুটে চলছি। গন্তব্য কোথায় আমাদের কি জানা আছে?

এইসব চিন্তা আমার চলার গতিকে ধীর করে দেয়। আমি দর্শক হয়ে সবার তড়পানো দেখি। তাদের হাসিকান্না, কষ্ট, অকারণ স্যাক্রিফাইস আমাকে কষ্ট দেয়। আমাদের আসলে কিছু পাওয়া থাকে না। জন্ম এবং মৃত্যুর মধ্যকার গ্যাপটুকু অহেতুক টাস্ক দিয়ে ভরাট করার কিইবা প্রয়োজন! দিনশেষে তাই আমি মুহুর্ত নিয়ে ভাবি। মুহুর্তের নিক্তিতে নিজের টিকে থাকাকে পরখ করে দেখতে চাই। কে জানে, হয়তো আমার এই প্রচেষ্টাটুকুরও কোন অর্থ হয় না। তবুও, নিজের মতো করে জীবনকে আসলে যাপন করে যাওয়াটাই আসলে মূখ্য।

তাই, প্রতিনিয়ত নিজেকে মন্ত্রের মতো বলতে থাকি, ধীরে চলো বৎস..ধীরে..। বিনয়ী থাকো, সহজ থাকো। ক্ষুদ্রতার অস্তিত্বের বাইরে যাওয়ার সাধ্য আমার নেই। সেকরাণেই হয়তো আমি কেবল মুহুর্তকে যাপন করে যেতে চাই।

Leave a Comment