Hafizul Islam

আমার মৃত্যুর দিনটি যেমন হতে পারে

পড়েছেন: 107 জন পাঠক

– শুনছেন! মুনশি বাড়ির মফিজলের পোলা রনি নাকি মইরা গ্যাছে!
– কোন রনি?
– আরে! ফিরোজসাবগো বাড়ির চান্দু আছে না? চান্দুর ছোড ভাইয়ের পোলা। ঢাকা শহরে বড় ভার্সিটিত্ আছিল।
– অঅঅঅ! আমাগো মইজুলের পোলাডা! বদিয়ার নাতি! আহারে! পোলাডা আদব কায়দা জানতো। আমার লগে একবার রমযান মাসে  তারাবির পরে কথা হইছিলো।

উপরের আলাপটা আমার গ্রামের কোন এক স্বল্প পরিচিতি পরিবারের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার আলাপ। আমি সেদিন মারা গিয়েছি। এইভাবেই আমার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ছে। আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-সহপাঠি সবাই ধীরগতিতে জানতে শুরু করেছে, আমি নেই। আমার বাড়িতে ডাকনাম হচ্ছে রনি। আমার ভীষণ প্রিয় বড়মামির দেয়া নাম। বিলাপ করে কান্না আমার মায়ের পছন্দ না। কিন্তু, তিনি জোর আওয়াজে বিলাপ করে কাঁদছেন। তার সবেধন নীলমণি একমাত্র ছেলে এমন হুট করে নাই হয়ে যাবে, দিন কখনো ভাবেন নি। বাবাকে দেখতে পাছি, একপাশে চুপচাপ বসে আসেন পাথরের মূর্তি হয়ে।

আমার দাদা যখন মারা যায়, তখন আমি অনেক ছোট। বাবার প্রতিক্রিয়া কেমন ছিলো, সেটা জানতাম না। কিন্তু, দাদীর মৃত্যুর সময় দেখা বাবাকে আমার মনে আছে। সারারাত দাদীর লাশের খাট বাড়ির উঠানে রাখা ছিলো। দূর দূরান্তের আত্মীয়রা আসতে আসতে ভোর হবে। তখন জানাজা হবে। বাবা লাশের কাছাকাছি একটি মাটির ঘরের সিঁড়িতে বসে আছে। কোন কথা নেই। শীতের রাতে কুয়াশায় ভিজে উঠছে উঠোন। দাদীর শববাহী খাটের উপরের আরবি লেখা চাদরে জমছে কুয়াশার বিন্দু বিন্দু জল। উঠানের এককোণে মেজো চাচার ঘরের বাইরে অল্প আলোর একটা লাল লাইট জ্বলছে টিমটিম করে। এই আলো যেনো বাড়িয়ে তুলছে মৃত্যুর শোকে স্তব্ধ মুনশি বাড়ির আঙিনার অনুবাদ অযোগ্য নৈঃশব্দের ভার।

বাবা এই আধো অন্ধকারে চুপচাপ বসে আছেন একটা পাতলা জামা গায়ে। কোন শোক প্রকাশ নেই। কোন বিরক্তি, রাগ, অভিযোগ কিচ্ছু নেই। নিরেট পাথরের মতো বসে আছে দাদীর সবচেয়ে ছোট এবং একরোখা ছেলেটি। এই দৃশ্য আমার চোখ বন্ধ করলেই আমি দেখতে পাই।।

আজকে আমার মৃত্যুদিনেও বাবা তেমনকরেই স্তব্ধ হয়ে আছেন। এই নীরবতার ওজন বুঝে উঠা মুশকিল। আমার আদরের ছোটবোন এখনো ঘটনার আকস্মিকতা মেনে নিতে পারছে না। কী করবে, কোথায় যাবে, কার সাথে কথা বলবে, দিশেই পাচ্ছে না বেচারি। অতিরিক্ত মানুষ কিংবা আত্মীয়-স্বজনের ভিড় ওর মোটেও পছন্দ না। ফলে এই মরাবাড়ির হুজুগের শোক ওর পক্ষে সহজে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু, ওর বড় ভাই ওর কাছে অনেক প্রিয় একটি মানুষ ছিলো। বাড়ির কেউ ওকে বুঝতে না চাইলেও বয়সে অনেক ব্যবধান থাকার পরও রনি ভাইয়া ওকে বুঝতো। ওর মতামতের গুরুত্ব দিতো। এখন ভাইয়া আর আসবে না। এতো বড় সত্যটা প্রসেস করার মতো পর্যাপ্ত সাহস কিংবা ইচ্ছা কিংবা শক্তি – কোনটাই আমার বোনটা সঞ্চয় করতে পারছে না।

আমি ছায়ার মতো ভেসে বেড়াচ্ছি। আত্মীয়-বন্ধু-পরিজনদের ভিড় বাড়ছে। কেউ দুঃখ বোধ করছেন। কেউ দায়িত্বের খাতিরে এসেছেন। আবার কেউ মরাবাড়ি দেখতে এসেছে। মানুষের কান্নায় স্যাতস্যাতে হয়ে আছে সেদিনের সন্ধ্যার বাতাস। আমার রুমের জানালা দিয়ে উত্তরের মৃদু হাওয়া বইছে। আমি দেখছি আমার মৃত্যুর দিন।

ভার্সিটির বন্ধুরা খবর পেয়ে কেউ একজন কোন একটা ফেসবুক গ্রুপে সেই খবর পোস্ট করেছে। দলে দলে শিক্ষার্থীরা শোক জানিয়ে যাচ্ছে। আমাদের মিরপুরের বাসের জনগণ শক ও শোকের ধাক্কায় বেহাল অবস্থা। এরমধ্যে ফাহিম হঠাৎ বলে উঠলো, এ্যই! চল। আমরা নীরবদের বাড়িতে যাই। অন্তত জানাজাটাতে অংশ নিতে পারি। তোরা যাবি? চল। এশা, হান্না, তাসফিয়া, লাবিব, ওরা হয়তো কোনভাবে সময় সুযোগ করে বেড়িয়ে পড়েছে আমার বাড়ির উদ্দেশ্যে, তাদের বন্ধুকে শেষ একবার দেখার জন্য। কী অদ্ভূত এই মৃত্যু! এই বন্ধুদের আমি সবসময় চেয়েছি আমার বাড়িতে দাওয়াত করতে। ব্যাটে-বলে মিলে নি বলে ওদের আসা হয় নি। আজকে ওরা আসছে। কিন্তু, আমি তখন আলোর গতিতে হয়তো ছুটছি। কোথায় গন্তব্য, জানা নেই।

আমার প্রাক্তন প্রেমিকা ও বর্তমান বউ অন্তরা ঠিক কী করছে, সেটা কল্পনায় বের করা কঠিন হচ্ছে। অথবা বলা যায়, ওর ভেঙে পড়ার বিষয়টি আমি কখনো দেখতে চাই না বলেই হয়তো আমি ওকে অসহায় কোন অবস্থাতে ভাবতে পারছি না। ওর সবচে বড় অনুভব হবে হয়তো, একজন পরিবর্তন সম্ভব না- এমন প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলেছে ও। এই চিন্তাটা ওর জন্য মেনে নেয়া সম্ভব হতে অনেক সময় লেগে যাবে। যদিও আমি এটা চাইছি না। হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো আমি প্রাণপনে চাইছি, এই শোক ওকে এড়িয়ে যাক। একটু একটু জমানো ওর সব অর্জন ওকে শক্তিশালী রাখুক।

হঠাৎ দেখলাম ঘরের জানালা দিয়ে দুয়েকজন ব্যক্তি উঁকিঝুকি করছে। একজন তাদের কাছে জানতে চাইছে, তারা এই মৃতব্যক্তির কিছু হয় কিনা। কিংবা, কী দরকারে তারা এখানে আসছে। এদের মধ্যে একজন বললেন, আমি ভাই পাওনাদার। যে মরছে সে আমার থেইক্যা টাকা নিছিলো। এই ট্যাকা আমি এখন কারথেকে লমু! পাওনাদার যে অংক আমার চাচাকে বলেছেন, সেই অংকটি মোটেও আমার ঋণের পরিমাণ নয়। বরং কোন আলাদা হিসাবের খাতাপত্র-লেখাজোকা কিছু না থাকায় পাওনাদার তার ইচ্ছামতো একটা অংক বসিয়ে দিয়েছে।

বাড়ির আঙিনায় জায়গার অভাবে পাশের বাড়ির উঠোনে মুরুব্বিরা জমায়েত হচ্ছেন। রাত নামার পরপরই জানাজা হয়ে যাবে, এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মিরপুরের বন্ধুরা এসে পৌঁছেছে কিছুক্ষণ হলো। ওদের একজনের চোখের পানিতে বন্যা হয়ে যাচ্ছে। মানবতার আম্মা ডাকনামের বন্ধুটার চোখের জল কোনভাবেই বাধ মানছে না। ওরা সবাই একপাশে দাঁড়িয়ে আছে আমার অপেক্ষায়। বন্ধুদের মিটআপ-আড্ডগুলোতে আমি বেশিরভাগ সময় ওদের সবার জন্য অপেক্ষা করতাম। আজকে ওরা আমার জন্য অপেক্ষায় আছে। এই অপেক্ষা আমাদের শেষ অপেক্ষা।

আমাকে গোসল দিয়ে আনা হয়েছে বাড়ির উঠানে। সেই ছোটবেলায় বাড়ি ছেড়ে হোস্টেলে চলে যাবার পর থেকে এতো মানুষ কখনো আমাদের পরিবারের কোন আয়োজনে আসে নি। সাদা কাপড় মোড়া লাশ হয়ে থাকা আমাকে দেখে চারপাশে থমথম নীরবতা আরো গাঢ় হয়ে উঠছে। ঘরের ভেতর থেকে বন্ধ দরজা পেরিয়ে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো। একটু পরেই আমার যাত্রা শুরু হলো চারপায়ার খাটে চড়ে। ছোটবেলায় কারো লাশ নিতে দেখলে আমার খুব ইচ্ছা হতো, মৃতব্যক্তির খাটে উঠে বসি।

এই কফিনজার্ণিতেও হয়তো কোন কিশোর আছে। যার ইচ্ছা করছে আমার পাশে মৃতের খাটে বসতে। হয়তো সেও কখনো আমার মতো মৃত্যুদিনে কফিনজার্ণিতে বের হবে। অন্য আরেকজন কিশোর হয়তো আমার মতোই ভাববে। এই সংক্ষেপ জার্ণি শেষে কিছু মানুষজন মিলে রাতের অন্ধকারে অনন্তের দরজায় রেখে চলে গেলো। রাতের অন্ধকার সহ্য করতে না পারা আমি শুয়ে রইলাম ঘুটঘুটে অন্ধকারের মেঠোগন্ধের কোন এক কবরে।

আগামীকালের সূর্যটা আমার আর দেখা হবে না। আর কখনো আমি আর ছোটবোন বসে ফিসফাস করে গল্প করবো না। কখনো আর মিরপুরের টি-ট্রিতে বসে কফির মগ হাতে উচ্চকন্ঠে আড্ডা দেয়া হবে না। সবকিছু বদলে গেলো আজকের এই আমার মৃত্যুদিনে। নেটফ্লিক্সের শেষ না হওয়া সিরিজ, মাথার উপর ঝুলে থাকা মাস্টার্স ফাইনাল, জাহাঙ্গীরনগরের মুরাদ চত্তর, ফটোগ্রাফি চত্তর, মুক্তমঞ্চ, ক্যাফেটরিয়ার সকালের লুচি-ডাল, টাকা ধার করে খাওয়া ফোরসিজনের পিজ্জা, নোমান মাস্টারের সাথে লম্বা গল্প, ইংলিশের জুনিয়রদের সাথে চা-চক্র, পাহাড়ের ঢালে ঝুম বৃষ্টিতে ক্যাম্পিং, হামহামের ফ্লাশফ্লাড এমন অসংখ্য স্মৃতি দ্রুতগতিতে ফিল্মের রিলের মতো চলে চলে শেষ হতে থাকছে।

আমার প্রথম দেখার বগাকাইন লেক, প্রথম প্রেমে পড়া, প্রথম চাকরির ইন্টারভিউ, প্রথম বেতন পাওয়া, মায়ের হাত ধরে প্রথম স্কুলে যাওয়া এমন সবকিছুই মনে পড়ছে। এই লিস্টের দৈর্ঘ্য বাড়তে বাড়তে কোথায় যাচ্ছে, জানা নেই। মনে হচ্ছে যে জীবন ফেলে এসেছি, সেই জীবনটাকে হয়তো আরেকটু সহজ করা যেতে পারতো। হয়তো  আরেকটু বেশি মানবিক মানুষ হতে পারতাম। হয়তো এমন মৃত্যুদিনের জন্য প্রতিদিন একটু করে প্রস্তুতি নেয়া যেতো। আরেকটু বিনয়ী হয়তো হতে পারতাম। এই হয়তো হতে পারার কথা ভাবতে ভাবতে আমাকে কাটাতে হবে অনিঃশেষ আগামীর সবটুকু।

আমার মৃত্যুর দিনে সবাই যদি আনন্দ করে আমাকে বিদায় জানাতো, আমার খুব ভালো লাগতো। যদি আমার এই মৃত্যুদিনে আমি শতভাগ নিশ্চিত হতে পারতাম যে, আমাদের শোকবাড়িতে উপস্থিত ও অনুপস্থিত আমার প্রিয়জনরা আমার মৃত্যুকে স্বাভাবিক একটি অনুষঙ্গ হিসেবে নিয়েছে, তাহলে অনন্তের পথে আমার সুদীর্ঘ জার্ণিটা উপভোগ্য হতো।

আমার এই মৃত্যুদিনে আমি প্রাণপনে প্রার্থনা করছি, যেনো আমি আমার প্রিয়জনদের আনন্দের কারণ হই সবসময়। আমাকে যেনো কোন ধরণের ট্যাগ ছাড়া সহজ একজন মানুষ হিসাবে সবাই বিদায় দেয়। যেরকম সহজ মানুষ আমি হতে চেয়েছি, সেরকম মানুষের সংখ্যা বাড়ুক। কে জানে, হয়তো শেষ প্রার্থনা বলে সৃষ্টা আমার আর্জি মেনে নিবেন। ভালো রাখবেন আমার প্রিয়জনদের।

ঘাসের দলে মাটির গন্ধে আমার চোখে ঘুম নামুক। হাজার বছরের পুরনো প্রশান্তির ঘুম। সেপিয়া কালারের মেলানকলিক কোন নাগরিক সন্ধ্যায় আমার মতো কারো সাথে দেখা হলে তাকে বলো, কেমন আছিস রে বন্ধু? শান্তিতে আছিস তো তুই? চল, আজকে তোকে ট্রিট দিই!

Leave a Comment