Hafizul Islam

প্রিয় ও অপ্রিয়, স্মরণীয় এবং ভুলে যেতে চাওয়া শিক্ষকবৃন্দকে ধন্যবাদ!

পড়েছেন: 126 জন পাঠক

ছোটবেলায় শিক্ষাগুরুর মর্যাদার গল্প পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। একজন শিক্ষকের সম্মানের বিষয়টিই সেখানে গুরুত্ব সহকারে বর্ণনা করা হয়েছিলো। শৈশব পেরিয়ে ঢাকায় এসেছিলাম উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার আকাঙক্ষা নিয়ে। তারপর নানা ধরনের শিক্ষাপদ্ধতির মধ্য দিয়ে বহুপথ পার হয়েছি। শেখা ও না শেখার জার্নিতে শিক্ষকবৃন্দ ছিলেন সুহৃদ কিংবা বিপরীত ভূমিকায়। তাদের নিয়ে লিখছি আজকের ব্লগ।

গ্রামের মক্তবে একজন শিক্ষক আমাকে প্রভাবিত করেছিলেন। তার নাম ছিলো আলাউদ্দিন। লম্বা-চওড়া কাঠামোর মানুষটি ভীষণ রাগী ছিলেন। কিন্তু, কোন এক অদ্ভূত কারণে আমাকে ভালোবাসতেন। আমরা তাকে ডাকতাম আলাউদ্দি হুজুর বলে। উনি আমাদের সবসময় সামনে এগিয়ে নিতে চেষ্টা করতেন।

গ্রামের মসজিদে বিভিন্ন আয়োজন অনুষ্ঠানে তিনি আমাদের কয়েকজনকে মাইকের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতেন। ডায়াসে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতা তখনই আমার প্রথম। শৈশবে নিজের উপর বিশ্বাসের জায়গাটি হয়তো তখনই অজান্তেই তৈরী হতে থেকেছিলো।

গ্রামে আমাদের প্রাইমারি স্কুলের নাম ছিলো ১৯ নং লক্ষীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। তখন সদ্য আমরা শহুরে জীবন ছেড়ে গ্রামে থিতু হয়েছি। স্কুলে গিয়ে দেখলাম ক্লাস ওয়ানের শিক্ষার্থীরা ফ্লোরে বসে ক্লাস করছে। ক্ষয়ে যাওয়া মেঝেতে ইটের চেহারা দেখা যাচ্ছিলো। নাগরিক আদবকেতায় বড় হওয়া আমার পক্ষে স্কুলের এই অবস্থা মেনে নেয়া বেশ কঠিন ছিলো। কিছুদিন আন্দোলন করে ব্যর্থতা মেনে নিয়ে শুরু হলো আমার স্কুলজীবন। আমি ছিলাম ক শাখায়। বেজোড় সংখ্যার ক্লাসরোল যাদের তারা ছিলৈা ক শাখায়।

ঢাকায় এসে প্রথম যেখানে পড়াশোনা শুরু করি, প্রতিষ্ঠানটি ছিলো সদরঘাটে। বাবার কর্মস্থল ছিলো সদরঘাটে ফায়ার সার্ভিস। সেই সুবাদে বাবার অফিসের পাশেই ছিলো আমার মাদরাসা। বাবা-মা সম্ভবত মানত করেছিলেন  আমাকে মাদরাসায় পড়াবেন। আমি কী হতে চাইতে পারি, সে সকল অপশন খোঁজার অবকাশ পাই নি। পরিবার থেকে আলাদা হয়ে হোস্টেলে থাকা শুরু করলাম।

নাজমুল হাসান নামের একজন শিক্ষক আমার জীবনের বাঁক পরিবর্তনে মৌলিক ভূমিকায় ছিলেন। একই প্রতিষ্ঠান থেকে আমাকে হুট করে বের হয়ে যেতে হয়েছিলো অন্য একজন শিক্ষকের ভয়ংকর কাজকর্মের ফলশ্রুতিতে। একধরণের মানসিক ট্রমা পিরিয়ড কেটেছে তখন। এতোবছর পর সেই ভুলে যেতে চাওয়া শিক্ষকের নাম মনে করতে পারি না। কিন্তু, উনি যে দুঃসহ অভিজ্ঞতা আমাকে সহ্য করতে বাধ্য করেছেন, নেই স্মৃতি কখনো আমার মোমেরি থেকে মুছে গেলে বরং স্বস্তি পেতাম।

নাজমুল হাসান আমাকে রীতিমতো পথ দেখিয়েছেন সেই জটিল সময়ে। টেনে নিয়ে গিয়েছেন নিজের সাথে করে। বিষয়টি আমার জীবনের পথকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ট্র্যাকে চলতে সাহায্য করেছিলো।

পাটুয়াটুলি, সদরঘাটের পাঠ চুকিয়ে প্রিয় শিক্ষক নাজমুল হাসানের সাথে এই প্রতিষ্ঠান সেই প্রতিষ্ঠান করে হিফজ (ক্বোরআন মুখস্থ) শেষ করলাম। নতুন ধাপের দিকে তিনি এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখালেন। হাজিপাড়া, রামপুরাতে একটি মাদরাসায় (কিতাবখানা) আমার নতুন পড়াশোনা শুরু হলো। প্রচলিত দাওরায়ে হাদিস মাদরাসার সিলেবাস ও ধ্যান-ধারণার সাথে এই মাদরাসার ব্যপক তফাৎ ছিলো। যেটা পরবর্তীতে বুঝতে পেরেছিলাম।

এই প্রতিষ্ঠানটি আমার মানসিক গড়ন, চিন্তার ভিন্নতা, প্রশ্ন করতে শেখা, দ্বিমতের সাহস করা, নিজের মত স্বশব্দে জানান দেয়ার শক্তির ভিত্তি তৈরী করে দিয়েছিলো। আমার দীর্ঘ শিক্ষাজীবনের সবচে অসাধারণ কিছু শিক্ষক আমি এখানে এসে পেয়েছিলাম।

রাতদিন পড়াশোনা করার আনন্দ এখানে প্রথম পেতে শুরু করি। মাদরাসার কিতাবাদির পাশাপাশি এখানেই প্রথম হার্ডকোর টাইপের সিরিয়াস বাংলা বই পড়তে শুরু করি। সাহিত্য-সংস্কৃতি, ধর্মীয় আলাপের বাইরের জগত ইত্যাদি ঢুকতে শুরু করে মনের জানালা দিয়ে। ৩ জনের একটা গ্রুপ ছিলো আমাদের। দুর্দান্ত এই গ্রুপটির কাছে আমি সবসময় কৃতজ্ঞ।

তখন খিলগাঁও কলেজের পাশে তালতলায় একটা পাঠাগার ছিলো। সমৃদ্ধ এই পাঠাগারে আমি প্রথম এতো বাংলা বই একসাথে দেখি। সদস্য হয়ে আমরা প্রতিদিন বই নিয়ে যেতাম মাদরাসার বিকাল বেলার অবসরে। তারপর গোগ্রাসে পালাক্রমে পড়া হতো সেই বই। মাদরাসার বই/কিতাবগুলোর আকার-আকৃতি প্রচলিত বইপত্রের চেয়ে বড় হয়ে থাকে। সেসব বৃহৎ বইয়ের আড়ালে ক্লাসের মধ্যেই পড়া হতো বাংলা বিভিন্ন বই।

কোন বাছবিচার করার ইচ্ছা ও সুযোগ ছিলো না। যে বইটাই নিতাম, দেখতাম কতোকিছু জানি না। জানা লাগবে। সেই তাগিদ থেকে পড়াটা চলতো। এখানে আমার পরিচয় হয় রুহুল আমীন নামের আরেকজন দারুন মানুষের সাথে। শিক্ষক হিসেবে সবদিক থেকে যোগ্য এই মানুষটি আমাদের তখনকার সময়ে হিরো ছিলো সবার কাছে।

জানাশোনার কোন শেষ ছিলো না। পোশাক-আশাক-ব্যক্তিত্ব সবমিলে মুগ্ধতার ডিপো ছিলেন। কতো নতুন বিষয় জানাতেন। পড়াশোনা করেছিলেন ইন্ডিয়ার বিখ্যাত মাদরাসা দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে। সেখানের নানান গল্প বলতেন। আমরা চুপ করে শুনতাম। উনার প্রতি এই মুগ্ধতা আমার কাটে নি কখনো।

প্রয়োজনে অনেক প্রতিষ্ঠান পাল্টাতে হয়েছে। কখনো স্বেচ্ছায় আবার কখনো পরিস্থিতির কারণে। কিন্তু, রুহুল আমীন নামের এই মানুষটিকে আমার সবসময় মনে পড়েছে। এখনো মনে পড়ে। সরাসরি যোগাযোগ করার ইচ্ছা হয় না। খোঁজ জানি, ভালোই আছেন। হয়তো এতোদিন পর পড়াশোনার ট্র্যাক পাল্টে ফেলা শিক্ষার্থি আমাকে দেখে উনার ভালো লাগবে না। তাই আর সরাসরি সাক্ষাতের সাহস করি না। তবুও এটা ভেবে ভালো লাগে যে, আমাদের একসাথে কাটানো সময়টা আসলেই ভালো ছিলো।

ইকরা বাংলাদেশ নামের সেই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে নতুন নতুন আরো প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ করে নিতে হয়েছে। কিন্তু, রুহুল আমীনের মতো এমন মনে দাগকেটে যাওয়া শিক্ষকের দেখা খুব একটা পাই নি।

তারপর নানা পালাবদলের পর পড়াশোনার স্টেজ গিয়ে পড়লো কীর্তনখোলার পাড়ের এক বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এতো বিশাল আকারের মাদরাসায় আমি সেই প্রথম। একেকদিন কয়েক মণ ওজনের চাল রান্না হতো। লম্বা লাইনে ছোট সাইজের বালতি হাতে নিয়ে খাবারের জন্য দাঁড়াতাম। ২ বেলা ভাতের ব্যবস্থা ছিলো এখানে। প্রায় সব শিক্ষার্থির খাবার ও আবাসন বিনামূল্যে করা হতো। তাই, যা পাওয়া যেতো ফ্রি ব্যবস্থায় সেটা নিয়েই সবাইকে সন্তুষ্ট থাকতে হতো।

আমি যেদিন বোর্ডিং ম্যানেজারকে বললাম যে, আমি ফ্রিতে খাবার নিতে চাই না। চার্জ কতো পড়বে, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে উনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, টাকা দিয়ে খাবেন কেনো!!!! আপনিতো ফ্রিতে খাবারের জন্য যে মার্কস পাওয়া দরকার, সেটাতো পেয়েছেনই!!! সেই প্রথম আমি জানলাম, খাবারের মার্কস নামে একটা বিষয় মাদরাসাগুলোতে প্রচলিত আছে।

এই মাদরাসায় আমি সরকারি সার্টিফিকেটের জন্য বোর্ড পরীক্ষায় অংশ নিতে ভর্তি হয়েছিলাম। এখানের সময়টুকু বেশ অদ্ভূত রকমের ভিন্নতায় ভরা ছিলো। কীর্তনখোলার পাড়ে জমি থেকে ধান কেটে নৌকায় করে নদী পার হয়ে সেই ধান শিক্ষকের উঠানে রোদ দেয়ার অভিজ্ঞতা এখানে প্রথম হয়েছিলো। জোয়ারের পর ভাটার টানে যখন নদীর পানি নেনে যেতো তখন সেখানে ছোট ছোট গর্তে হাত দিয়ে মাছ ধরতাম। ডগরি নামের ছোট ছোট মাছগুলো তিড়িং করে বেরিয়ে আসতো।

হাটু পর্যন্ত কাদায় ডুবে থাকতো পা। সেই মাছ একসাথে জমা করে মাদরাসার ছাদে ইটের নিজেদের বানানো চুলায় ঝুড়ঝুড়ে করে ভাজা হতো। আবার কখনো বাজারের হোটেলে গিয়ে রান্না করে নিয়ে আসা হতো। তারপর নিয়ম ভেঙে আমরা ডিনার টাইমের পরোয়া না করে তৃপ্তি নিয়ে খেতাম স্বাদু পানির ডগরি মাছের ঝুরি কিংবা টমেটো দিয়ে রান্না করে ঝোল। আহা!

চরমোনাই মাদরাসায় তখন আমার সাথে পরিচয় হয় একজন শিক্ষকের। উনার নাম আবু হানিফ। খুব সাদাসিধে ছিমছাম একজন মানুষ ছিলেন। নদীর পাড়ের জনপদের মানুষ। গায়ের রঙে তীব্র রোদের ছাপ স্পষ্ট। পুরনো রঙজ্বলা কাপড়ের পাঞ্জাবি, ছোট ছোট চেকের লুঙ্গি পড়ে একমনে হেঁটে যেতেন রাস্তা ধরে। মাঝেমধ্যেই হাতে থাকতো উনার ট্রেডমার্ক ১০ শিকের ছাতা। কোন এককালে ছাতার রঙ কালো ছিলো, এটা বুঝা যেতো ছাতার ভেতরের অংশের দিকে তাকালে। কেউ যখন জানতে চাইতো, কেমন আছেন তিনি, খুব আন্তরিক একটা হাসি দিয়ে বলতেন, আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন তো?।

নিঃশব্দ কিন্তু মুচকি হাসির আন্তরিকতা ছড়িয়ে পড়তে দেখতাম আমি। মাদরাসার সবচেয়ে ছোট পর্যায়ের শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু,  মানুষ হিসেবে অসম্ভব সৎ ছিলেন বলে কর্তাব্যক্তিরাও সবসময় উনাকে সামলে চলতে চাইতো। কোন ধরণের অন্যায় ও অনায্য আচরণ করতে দেখি নি উনাকে। কারো কাছ থেকে কোন উপহার নিতেন না। কখনো ট্রিট দেয়ার সুযোগ দিতেন না কাউকে। কোন ধরণের ঋণী থাকা পছন্দ করতেন না। এমন একরোখা ও নীতি মেনে চলা মানুষ আমার চোখে আরেকটা পড়ে নি।

একদিন অবসর সময়ে জানতে চেয়েছিলাম, এমন কঠোর নিয়ম মানা জীবন কেনো যাপন করেন। উত্তর দিয়েছিলেন, “আমি অতো ভালোমন্দ বুঝি না। শুধু বুঝি, কারো কষ্টের কারণ না হয়ে আমি আমার মতো জীবন কাটিয়ে ফেলতে পারলেই বেঁচে যাই।” কোন আড়ম্বর নেই। লোকদেখানো আনুষ্ঠানিকতা নেই। উনাকে দেখলে আমার মনে হতো, একচিলতে স্বস্তির জীবন যেনো গা এলিয়ে দিয়ে পড়ে আছে কীর্তনখোলা পাড়ের এই গ্রামে।

বরিশালের পড়াশোনার অধ্যায় শেষ হয় ওখান থেকে দাখিল সার্টিফিকেট পরীক্ষা দেয়ার মাধ্যমে। এক্সাম শেষে এইচএসসিতে ভর্তি হই ঢাকা কলেজে। একইসাথে দাওরায়ে হাদীস (মাদরাসার শেষ বর্ষ/মাস্টার্স সমমানের বর্ষ) পড়ার জন্য চট্টগ্রামের হাটহাজারি মাদরাসায় ভর্তি হই। এখানে ভর্তির জার্ণিটা বেশ লম্বা আর বিব্রতকর ছিলো আমার জন্য। মূল ভর্তি পরীক্ষার অংশটুকু ঠিকঠাক হলেও এডমিশন প্রসিডিউর ছিলো মাদরাসার নিজস্ব স্ট্যান্ডার্ডে। যেটা আমার কাছে চরম অগোছালো লেগেছিলো।

শিক্ষার্থী সংখ্যার দিক থেকে সাগরের মতো মহা ছিলো হাটহাজারি মাদরাসা। আমাদের ক্লাসে ছাড়া সংখ্যা ছিলো প্রায় ১৮০০+। ছোটখাটো একটা মাঠের মতো একাডেমিক রুমে আমাদের দারস (ক্লাস) হতো। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত একটানা ক্লাস চলতে থাকতো। শিক্ষার্থিরা নিজেদের কাজকর্ম সব এরমধ্যেই করে নিতো। শুধু বিকালবেলা একটু ফ্রি সময় মিলতো মিলাদের পর তবারকের মতো করে।

এখানের ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়ার পর জেনেছিলাম যে, আমার খাওয়ার মার্কস আমি রাখতে পেরেছিলাম। তাই, মাদরাসার বোর্ডিং থেকে ভাত এনে নিজেদের রান্না করে তরকারি দিয়ে খাওয়া হতো কখনো কখনো। বেশিরভাগ আশেপাশের হোটেলে কোন একরকম খেয়ে নিতাম। হাটহাজারিতে পরিত্যক্ত ছোট রেলস্টেশনের পাশে একটা টংদোকান ছিলো। ওখানে ডুবোতেলে পরোটা ভাজতো। সাথে দিতে ফ্রিতে মোটাদানার চিনি। সকাল সকাল সেই গরম পরোটার তৃপ্তি ছিলো চমৎকার। একদিকে  মাদরাসা ও অন্যদিকে কলেজের পড়াশোনা একসাথে চালিয়ে নিচ্ছিলাম।

এই পর্যায়ে মনে রাখার মতো কোন শিক্ষকের কথা আমার স্মরণ হয় না। অগণিত শিক্ষক আসতেন। পড়াতেন। অনেকেই ছিলেন নিজস্ব ক্ষেত্রে ও পরিমন্ডলে বিখ্যাত মানুষ। কিন্তু, ব্যক্তিগতভাবে তাদের সাথে আমার কোন ধরণের সম্পর্ক গড়ে উঠে নি। তারপর সুযোগ হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। নিজের মেধার উপর ভরসা নেই। তাই বলি, ভাগ্যক্রমে চান্স পেয়ে গিয়েছিলাম।

বিশ্ববিদ্যালয় আমার কাছে একরকম অধরা গন্তব্যের মতো ছিলো। প্রচলিত মক্তব, মাদরাসা পার হয়ে কোন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ করা আমার জন্য মোটেও সহজ ছিলো না। পরিবারের অমত ছিলো। পথ দেখানোর মতো কোন অভিভাবক পাই নি। সহপাঠীদের কেউ সহযাত্রী হয় নি একই সময়ে। আমার ধারণা ছিলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পাঠদান করেন, তাদের যাদুকরি লেকচার কৌশল থাকবে নিশ্চয়ই।

কিন্তু, বাস্তবতা মোটেও তেমন হয় নি। স্কুল, কলেজ, ক্বওমি মাদরাসা, আলীয়া মাদরাসা ইত্যাদি নানা ধরণের শিক্ষাক্রম, অসংখ্য শিক্ষকের সান্নিধ্য আমাকে শিখিয়েছিলো, সুপারম্যান টাইপের শিক্ষকদের চিনতে। পুরনো অভিজ্ঞতা থেকে আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে আমার ভাবনার সাথে বাস্তবের ফারাক অনেকখানি।

কখনো নিজের ডিপার্টমেন্ট, কখনো সহপাঠি বন্ধুদের ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকবৃন্দ আমাকে হতাশ করেছেন। কেউ খুব ভালো পড়াতেন হয়তো। কিন্তু, ব্যক্তি মানুষ হিসেবে তারা ভিন্নরকম ছিলেন। কোন কোন শিক্ষকের পড়ানো শুরু হলেই বুঝে যেতাম যে, উনি বহুদিন ধরে নিজের লেকচার আপডেট করার সময় করে উঠতে পারেন নি। কেউ আবার প্রশ্ন করলে মনে করতেন চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে।

আমি বুঝতে পারি, বিভিন্ন রকমের জটিলতা, প্রাতিষ্ঠানিক অহেতুক চাপ, ক্ষমতা রাজনীতি, প্রমোশন ইত্যাদি নানা ধরণের অনুষঙ্গের মধ্য দিয়ে যেতে হয় ভার্সিটির একজন শিক্ষককে। সবকিছু শেষ করে দারুন একটা ক্লাস নেয়ার মতো অনুপ্রেরণা কিংবা ইচ্ছা আর বাকী থাকে না। কিন্তু, একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমিতো চাইবোই যে আমার শিক্ষক একজন সুপারম্যান হবেন। ভালো পড়ানোর পাশাপাশি তিনি একজন দারুন মানুষও হবেন।

শিক্ষকদের প্রতি মুগ্ধ হয়ে থাকার আকাঙক্ষা আমার সবসময় থাকবে। এখনো জাহাঙ্গীরনগরের পাট পুরোপুরি শেষ হয় নি। তাই, কোন নাম উল্লেখ না করেই এই পর্যায়ের শিক্ষকদের আলাপ শেষ করছি। তবে, আশার কথা হচ্ছে এখানেও কিছু শিক্ষক আমাকে হতাশ হওয়া থেকে বাঁচিয়েছেন। তাদের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

জীবনের লম্বা একটা জার্ণির প্রায় শেষপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। দেশের প্রচলিত শিক্ষার সময় শেষ আমার জন্য। একাডেমিক বিদ্যা আদৌ কিছু মাথায় আছে বলে মনে করি না। এই জার্নির নানা জায়গায় টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন অনুষঙ্গ দুহাতে কুড়িয়েছি। জেনেছি। প্রশ্ন করতে শিখেছি আরো গুছিয়ে। বুঝতে শিখেছি যে, কেমন মানুষ আমি হতে চাই না।

এই যাত্রায় আমার শিক্ষকেরা ছিলেন প্রিয় বন্ধুর মতো। কখনো অপ্রিয় শত্রুর মতো। আবার কখনো বিরক্তিকর প্রতিবেশি হয়ে। সকল শিক্ষকদের কাউকে ভালোবেসেছি। কাউকে মনে রেখে দিতে চেয়েছি যত্ন করে। আবার কারো অস্তিত্ব ভুলে যেতে চেয়েছি স্বস্তির জন্য।

সবকিছুর শেষে প্রিয় ও অপ্রিয়, স্মরণীয় এবং ভুলে যেতে চাওয়া আমার সকল শিক্ষকবৃন্দকে ধন্যবাদ! আপনারা ছিলেন বলেই আমি আমার মতো হতে পেরেছি। ভালো কিংবা মন্দ যেটাই হোক, জীবন আমাকে যেখানেই নিয়ে যাক, আপনাদের প্রতি আমার ঋণ শেষ হবার নয়।

তাই, স্রষ্টার কাছে প্রাণপনে চাই ভালো থাকুক পৃথিবীর সব সত্যিকারের শিক্ষকেরা। যারা ভালো একজন শিক্ষক হতে অবিরত চেষ্টা করে যান। পরাক্রমশালী স্বৈরাচার হয়ে না উঠে বরং শিক্ষার্থির নাগালে থাকেন বন্ধুর মতো।

Leave a Comment