Hafizul Islam

নারিন্দার নূর হোসেনের ভাজা মাছের ঘ্রাণে আমাদের মনখারাপ করা দুপুর

পড়েছেন: 43 জন পাঠক

কড়া করে তেলেভাজা মাছের ঘ্রাণ আমার প্রথমবার লোভনীয় মনে হয় অনেকদিন আগের এক গ্রীষ্মের দুপুরে। আমি তখন সদরঘাটের পাটুয়াটুলিতে বোর্ডিংয়ে থেকে পড়ছি। আমাদের সাথে নূর হোসেন নামের একজন ক্লাসমেট ছিলো। পুরান ঢাকার আদি বাসিন্দা হয়ে বেড়ে উঠলেও নূর হোসেনের বাড়ি কোথায় ছিলো, আমার জানা নেই। নারিন্দার কোন এক মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে নূর তার বাবার ভীষণ আদরের ছিলো।

প্রতিদিন দুপুরে ও রাতে ওর বাবা খাবার নিয়ে আসতো বাসা থেকে। নানা রকম ও স্বাদের তরকারি দিয়ে ওর খাওয়া দেখা আমাদের প্রতিদিনের একধরণের মন খারাপ করা বিষয়ই ছিলো বলে মনে পড়ে। বোর্ডিংয়ে তখন বেশিরভাগ দিন আধাকাঁচা ত্যালত্যালে পাঙ্গাস মাছের তরকারি পেতাম। সেই সময় নূর হোসেনের বাসা থেকে আসা খাবার দেখেই যেনো আমাদের অর্ধেক-ভোজন হয়ে যেতো।

সেরকমই একদিন নূর হোসেনের বাসা থেকে প্রমান সাইজের কড়া তেলেভাজা মাছের সাথে ঘি ও পোড়া মরিচ আসলো। কী দারুন ঘ্রাণ!! চোখ বন্ধ করলে আমি এখনো মনে হয় সেই মাছের ঘ্রাণ পাই। নূর হোসেন ভোজন রসিক ছিলো। দেখতে শুনতে গুলোমুলো ছিলো। আমার মনে পড়ে, আমরা তখন ওর শারীরিক অবস্থার জন্য মুটকো বলে খ্যাপাতাম। তখন খুব সাধারণ মনে হলেও আজকের এখানে বসে বুঝতে পারছি, অন্যায় আচরণ করেছিলাম।

যাইহোক। নূর আনমনে কড়কড়ে ভাজা মাছ খাচ্ছিলো কোন দিকেই খেয়াল না করে। ওর ঠিক সামনের সারিতে বসে আমি উটকো গন্ধের পাঙ্গাস খেতে খেতে দেখছিলাম। আমার লোলুপ দৃষ্টির তাকিয়ে থাকাতে নূরের পেটব্যথা করেছিলো কিনা, জানি না। তবে, আমার সেদিন খুব ভাজা মাছ খাওয়ার ভীষণ লোভ হয়েছিলো, এটা সত্যি।

নূর হোসেনকে আমার নানা কারণে মনে আছে। ওর কথা বলার ভঙ্গি, বেখেয়ালি চলাফেরা, বাবার আদর, মাঝে মধ্যে ওর মায়ের নিজের হাতে খাইয়ে দেয়া। সবকিছু আমার মনে পড়ে আজকাল। হয়তো সেকারণেই ওর সেদিনের দুপুরের মাছের কথা আমার পরিষ্কার মনে পড়ে। নূর হোসেনের সাথে আমার বোর্ডিংয়ের স্মৃতি বছরখানেকের।

তারপর আমি বোর্ডিং পাল্টে ফেলি। নূরের সাথে আমার আর কখনো দেখা হয় নি। জানি না নূর এখনো নারিন্দাতেই থাকে কিনা। বয়স বাড়তে বাড়তে এখন ওকে ঠিক কেমন দেখায়। ছোটবেলার সেই দুপুরগুলোতে সামনের সারিতে বসে আধাকাচা পাঙ্গাস মাছ খেতে থাকা আমাকে ওর মনে থাকার কথা না। কিন্তু, আমার মনে পড়ে।

বোর্ডিংয়ের সেই সময়গুলোতে চারপাশের নূর হোসেনের মতো মানুষগুলো আমাকে টিকে থাকতে শিখিয়েছে। ভাজা মাছ খেতে না পারা হয়তো অনেক সাধারণ ব্যপার। কিন্তু, এরকম অসংখ্য ছোট ছোট অপ্রাপ্তি, অসম্পূর্ণতা আমাকে নতুন করে ভালো কিছুর অপেক্ষায় থাকার জন্য প্রস্তুত করেছে। হয়তো আমার অজান্তেই।

আমাদের ছুটতে থাকা জীবনে থামার ফুসরত নেই। চুপচাপ শান্তিতে থাকার মতো সময় পাওয়া মুশকিল। আজকে দুপুরে চিংড়ির শুটকি দিয়ে বেশ তৃপ্তিতে ভাত খাওয়ার সময় আমার পেছনে ফেলে আসা নূর হোসেন ও সেদিনের ভাজা মাছের ঘ্রাণের কথা মনে পড়ছিলো। আহা!

আশা করি, কখনো আবার হয়তো নূরের সাথে আমার দেখা হয়ে যাবে পুরান ঢাকার কোন রাস্তায়। আমি তখন ওকে মুটকো বলে ক্ষ্যাপানোর জন্য, বডি শেমিংয়ের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিবো। সেদিন হয়তো আমরা বিউটি বোর্ডিং ইলিশ মাছ দিয়ে পেটভরে ভাত খাবো। গল্প করবো।

বোর্ডিংয়ে বোর্ডিংয়ে খাওয়ার মধ্য দিয়ে খাবারের প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা জন্মেছে। তাই, যখনই আমি তৃপ্তিসহ কিছু খেতে পাই, মনখুলে কৃতজ্ঞ হই খেতে পারছি বলে। নারিন্দার নূর হোসেন- আমাদের গুলোমুলো মুটকো, যেখানেই হোক যেভাবেই থাকুক, ভালো থাকুক। নূরের গ্রীষ্মের দুপুরগুলো এখনো যেনো চমৎকার খাবার ও তৃপ্তিতে ভরে থাকে।

Leave a Comment