Hafizul Islam

একদিন আমিও মা’কে নিয়ে লিখবো

পড়েছেন: 64 জন পাঠক

সেদিন বাড়ি থেকে ঢাকা ফিরছিলাম। আমাকে এগিয়ে দিতে মা আসছিলেন পেছন পেছন। আমার নিষেধ শুনতে না পাওয়ার বহুদিনের অভ্যাস নিয়ে উপজেলা সড়কের মাথা পর্যন্ত এলেন। স্বভাবসুলভ আওয়াজে বললেন, চিন্তা করিস না। খাইস ঠিকমতো। টাকা-পয়সা না থাকলে আগে আগে জানাইস। ব্যবস্থা হইবো নে।

আমার সাথের ব্যাগে দিয়ে দিয়েছেন জমানো দেশি মুরগীর ডিম, রান্না তরকারি, গাছের নতুন তীব্র ঘ্রাণছড়ানো কাগজী লেবু। ঈদে বানানো গুড়ের পাকানো খই আর চিড়ার মোয়ার দুটি পোটলাও সঙ্গে দিয়েছেন। যেদিন প্রথম আমি পড়াশোনার জন্য বাড়ি ছেড়ে ঢাকার পথে বের হই, সেদিন ভোরের দৃশ্যও এরকম ছিলো। এই সিনের পরিবর্তন হয় না সহজে। মা ব্যাগ ভর্তি করে দিয়ে চান নানারকম সামগ্রী।

কিন্তু, তারপরেও মা আমার খুব কাছের কেউ নন। মায়ের সাথে আমার আনন্দময় সময়ের প্রায় সবটুকুই যেনো শৈশবে আটকে আছে। তখন আমার আমার দুনিয়ার অনন্য একজন প্রিয়জন ছিলেন। মায়ের হাতে মাখানো খাবার না খেলে আমার খাওয়াই হতো না। মায়ের সঙ্গ ছেড়ে কখনো কোথাও যেতাম না।

একদিন রাগ করে বাড়ি থেকে না বলে নানুবাড়ি চলে গিয়েছিলাম। এ্যাডভেঞ্চারের উত্তেজনা শেষ হতেই মায়ের কথা মনে পড়ছিলো। ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে কাঁদতে ঘুুমিয়ে গিয়েছি। রাতে মা এসে খাবার খাইয়ে কোলে করে বাড়িতে নিয়ে আসলেন।

সেই রাতে জ্যোৎস্নার আলো উপচে পড়ছিলো। পাতিল উপচে পড়া দুধের মতো সাদা স্নিগ্ধ আলোয় নানুবাড়ির পাশের সড়ক দিয়ে হাঁটছি আমরা। আমি ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে আছি। মায়ের কোলে বসে দেখছি। মা হাঁটছেন। পাশে বাবাও হাঁটছেন।তখনকার দিনে আমাদের আশেপাশের গ্রামগুলোতে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে নি।

রাতের জ্যোৎস্না, রাস্তার ধারের ঝোপঝাড়ে উড়ন্ত জোনাকী, নানুদের কলপাড় থেকে ভেসে আসা ডাহুকের ডাক এখনো আমি চোখ বন্ধ করলে শুনতে পাই।

আমার জন্মের পর অনেকদিন পর্যন্ত আমি একমাত্র সন্তান ছিলাম। আমার ছোটবোনের সাথে আমার বয়সের তফাৎ প্রায় ১২/১৪ বছরের। এই দীর্ঘ সময়ে মায়ের সব ব্যস্ততা ছিলো আমাকে ঘিরে।

অবশ্য এখনো মায়ের নিজস্ব কোন গতিপথ নেই। সন্তানদের কেন্দ্র করেই তিনি ঘুরপাক খান অনবরত। আমাদের ভালো-মন্দ নিজের পছন্দের নিক্তিতে বিচার করে অভ্যস্ত আমাদের মা। এখনো বিপদে পড়লে হয়তো শেষ আশ্রয় হিসেবে মায়ের কাছেই ফিরবো আমরা।

তবুও, মা আমার খুব কাছের কেউ নন। সত্যিকারের যে আমি, মা কখনো তাকে জানেন না। ছোটবেলায় মাকে জড়িয়ে ধরার স্মৃতি আমার মনে আছে। কিন্তু, আমার মোমেরি থেকে মায়ের গায়ের ঘ্রাণ ধীরে ধীরে মুছে গেছে।

নানান অহেতুক কিংবা ক্ষুদ্র বিষয়ের চিন্তাগত পার্থক্য কিংবা ভিন্নমতের দেয়াল ক্রমশ বেড়ে উঠেছে আমাদের মাঝে। পারস্পরিক দূরত্ব বাড়ছে জ্যামিতিক গতিতে। আমার মাঝে মধ্যে ভয় হয়, হয়তো একসময় আমার শেকড়ে ফেরার পরিচয়টুকুও হারিয়ে যাবে এই গতিময়তার তালে।

চিটাগাং আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিস কলোনীতে একটি শিশুপার্ক ছিলো। ঠিক পাশেই আমাদের বিল্ডিং। প্রতিদিন বিকালে আমরা খেলতে যেতাম। আমাদের বাসা ছিলো দোতলায়। মা জানালা দিয়ে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকতেন, যেনো হারিয়ে না যাই। ওখানে থাকার সময় আমার মাথা-পা সহ শরীরজুড়ে একধরণের বিচ্ছিরি অসুখ হয়। বিছানায় শুতে পারতাম না। বালিশে রক্তের দাগ হয়ে যেতো।

সেই অসুস্থতার সময়গুলোতে মা ছুটোছুটি করে বেড়াতেন আমার একটু স্বস্তির জন্য। এ ডাক্তার ও ডাক্তার, এখানে ওখানে ছুটছেন। ফায়ারম্যান বাবার সময় ছিলো না বলে মা-ই ছিলেন আমার বাবা। আমাদের শোয়ার ঘরে একটাই খাট ছিলো। খাটের নীচ ভর্তি হয়ে ছিলো কাড়ি কাড়ি ঔষুধের বোতলে।

আমার পড়াশোনার হাতেখড়ি, স্কুল, প্রিয় বিকেল, নানুবাড়ি, বড়মামা সবখানেই আমার মা ছিলেন।  এখনো আছেন তিনি, নিজের মতো করে। আমাদের মধ্যকার পরস্পরকে বুঝতে না পারার অনিচ্ছুক ব্যর্থতা আমাদেরকে ক্রমশ অপরিচিত করে তুলছে।

দিশেহারা সময়ে নিজের শেকড় থেকে বিচ্ছিন্নতার জন্য নিজের প্রতি করুণা হয়। ভয় হয়, হয়তো আর কখনো আমার সত্যিকার অর্থে মায়ের কাছে ফেরা হবে না। মাঝে মধ্যে এমন অসহায় সময়ে ভাবি, যদি আমাদের মধ্যকার অলংঘনীয় দূরত্বটুকু কোন এক সকালে কুয়াশার মতো মিলিয়ে যেতো…। যদি আমি আবার মায়ের গায়ের ঘ্রাণ নিতে পারতাম…।

সেদিন নিশ্চয়ই আমি আবার আমার মায়ের কথা লিখবো। সেদিন নিশ্চয়ই মায়ের কথা মনে হলে দীর্ঘশ্বাসের পরিবর্তে মন ভালো হওয়া মুহুর্তের দেখা মিলবে। আমাদের মধ্যকার দূরত্ব যতোই থাকুক, প্রাণপনে চাই স্রষ্টা যেনো ভালো রাখুন মা’কে। সবকিছুর জন্য আন্তরিক ও বিনম্র কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাখি মায়ের জন্য।

আমি অযৌক্তিক মিরাকল কিংবা অলৌকিক কান্ডে বিশ্বাসী মানুষ। কোন একদিন আমরা আবার শৈশবের মতো আন্তরিক সময়ে ফিরতে পারবো বলে বিশ্বাস রাখতে চাই।

ছোটবেলার নানুবাড়ি থেকে ফেরা জ্যোৎস্নার রাত আবার আসুক। সেদিন অকারণ লোডশেডিং হোক। ভরা পূর্ণিমায় চাঁদের আলোয় ভিজে উঠুক আমাদের শরীর, মন, চারপাশের সবকিছু। আমি আবার যেনো আমার মায়ের কাছে ফিরে যেতে পারি, এমন দিন আসুক।

সেদিন অন্যদের মতো আমিও মা’কে নিয়ে লিখবো…।

Leave a Comment