Hafizul Islam

যেভাবে কাটিয়ে দিচ্ছি মেরুদণ্ডহীন ঢ্যাঁড়শমার্কা এক জীবন

পড়েছেন: 42 জন পাঠক

সকালে ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ মনে হচ্ছিলো, কী যেনো নেই নেই লাগছে। মেরুদণ্ডটা আবার হারিয়ে ফেলেছি। এই নিয়ে হাজারতম বারেরও বেশি সময়ের মতো মেরুদণ্ডটা হারালাম। স্পষ্ট দিনক্ষণ মনে নেই। খুব সম্ভবত যখন ঢাকায় প্রথম আসি, তার কিছুদিন পর আমার হোস্টেলেই ঘটেছিল মেরুদণ্ড হারানোর প্রথম উপলক্ষ্য। কনকনে শীতের রাতে ঘুমাতে যাবো। নতুন বানানো ধবধবে সাদা কভার লাগানো তুলতুলে লেপটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর দেখা গেলো, হোস্টেলের এক সিনিয়র আমার লেপের ওমে আরামে ঘুমাচ্ছেন। কিছুই বলতে পারিনি সেদিন। পাতলা কাঁথা গায়ে ভয়ংকর কষ্টেই গিয়েছিল মেরুদণ্ডহীন, প্রতিবাদ-অক্ষম আমার সেই রাত।

হোস্টেল থেকে ঠিক হলো, আমরা সবাই শিক্ষাসফরে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে যাবো। ঢাকা থেকে রিজার্ভ বাস। হোস্টেলে খাবার রান্না করে সাথে নেয়া হবে। প্রায় নিন্মমানের এক লোকাল বাস ভাড়া নিয়ে আমরা গেলাম। রাস্তার ভোগান্তি সবিস্তার বলার কিছু নেই। যাওয়ার পর সবাই নানারকম খেলাধূলা, সমুদ্রস্নান সেরে খেতে বসছে। খাওয়া চলার সময় জানা গেলো, আমরা যারা ধাক্কাধাক্কা না করে চুপচাপ লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নেয়ার অপেক্ষায় ছিলাম, আমাদের জন্য খাবার নেই। খাবার শেষ। ক্ষুধায় অন্ধকার দেখতে দেখতে অন্যদের সাথে খাবার ভাগ করে খেতে হয়েছিলো। অথচ, আমাদের দেয়া চাঁদার পরিমাণ সমান ছিলো। কিছুই বলতে পারিনি।

পরবর্তীতে এই বলতে না পারার উপলক্ষ্য কেবল বেড়েছেই। গতকাল অফিস শেষে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে মিরপুর আসছিলাম। রাত তখন সাড়ে নয়টার মতো। যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে বাসস্টপে অনেক যাত্রী দাঁড়িয়ে, গাড়ির অপেক্ষা। আমাদের বাসটি স্টপেজে থামতেই, ভয়াবহ হুড়োহুড়ি করে সবাই উঠতে শুরু করলো। এই ভিড়ের মধ্যে ভিন্ন বয়সের ৩/৪ জন নারী ছিলেন। যেভাবে তাদেরকে বাসে চড়তে হয়েছে, অবর্ণনীয়। চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে বিশ্রী গরমে তাদের চেহারায় বীভৎস আতংক আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। এমন অবস্থা নিত্যদিনই ঘটছে। আমরা চাইলে প্রতিবাদ করতে পারতাম। অন্তত, গতকাল আমি চিৎকার চেঁচামেচি করে হয়তো তাদের জন্য একটু স্বস্তিতে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করে দিতে পারতাম।

আমি এখানে মোটেও কোন জেন্ডার-নির্ভর সমাধান কিংবা স্পেশাল ট্রিটমেন্টের বিষয় বলছি না। আশেপাশের লোকজনের বিচ্ছিরি ভঙ্গিতে দাঁড়ানো, নারীদের দিকে অদ্ভূতভাবে তাকানো, তাদের অসহায়ত্ব দেখে হাসা, এর কোনটাই আমার সহ্য হচ্ছিলো না। বিরক্তিতে গা ঘিনঘিন করছিলো। কিন্তু, মিনমিন করা ছাড়া অবস্থা পাল্টে দিকে, এমন কিছুই করতে পারিনি। নিজের এই অক্ষমতা আমাকে মুখভ্যাংচি দিয়ে যেনো বলছিলো, মেরুদণ্ডহীন লোক।

ছোটবেলায় গ্রামে যখন ছিলাম, আমাদের পাশের বাড়িতে সাংসারিক অশান্তি, সহিংসতার ঘটনা ঘটতো। রাত হলেই ভেসে আসতো বাজখাঁই গলায় অশ্রাব্য সব গালির ছড়ড়া। কখনো বউ পেটানোর শব্দ। টিনের বেড়ায় ধুমধাম আওয়াজ। সকালে বাড়ি বউয়ে চেহারায় আঘাতের চিহ্ন ফুঁটে থাকতো রাতের আমলনামা হয়ে। কিন্তু, আমাদের বাড়ির বড়রা কখনো কিছু বলতে যেতো না। আমরা উসখুস করলে তারা বলতেন, ‘মাইনষের ঘরের জিনিস নিয়া পাকনামি করতে যাইস না।’ আমরাও পাকনামি করতে যেতাম না। একসময় আমার বিশ্বাস দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো, অন্যেরা বউ পেটালেও আমার কিছু করার দরকার নেই। এমনকি নূন্যতম মৌখিক প্রতিবাদও না।

প্রতিবাদ না করার অভ্যাস খুব সম্ভবত গড়ে উঠে অনেকদিন সময় নিয়ে। শৈশব থেকেই হয়তো। আমার বাড়িতে সবসময় শেখানো হয়েছে, কোন কিছু নিয়ে প্রতিবাদের কিছু নেই। হোস্টেলে নানা সময় ঘরোয়া আন্দোলন হতো। কখনো সেটার জেরে বন্ধ থাকতো হোস্টেল। আম্মা সবসময় বলতেন, চলে আয়। সামনে যাস না। তোর কিছু বলার দরকার নেই। ওদেরটা ওরা বুঝবে। বয়স যখন বাড়লো, খানিকটা বড় হতে শুরু করলাম, রাস্তা অবরোধ, অনশন, আন্দোলনে যাওয়া হতো মাঝেসাজে। কিন্তু, আম্মা জানলেই বলতেন, ‘সামনে আগাস না। ক্যানো গেছিস! তুই মনোযোগ দে পড়াশোনায়। আর কিছু করার দরকার নাই।’

একবার এক বড় আন্দোলনে সমমানসিকতার অনেক লোক জড়ো হচ্ছিলো সারাদেশ থেকে। আমার পরিচিত গণ্ডির লোকজন আশা করছিলো, আমিও হয়তো যাবো। কিন্তু, আমার যেতে ইচ্ছাই হয়নি। কারণ অবশ্য প্রতিবাদ না করতে চাওয়া নয়। বরং, আমার কাছে তাদের আন্দোলন একরকম অহেতুক অথবা বলা যায়, একপেশে লেগেছিলো। পরবর্তীতে তখনকার গণ্ডির লোকজন আমাকে রীতিমতো বয়কট করেছিলো। এরকম আপাতদৃষ্টিতে দেখতে সাংঘর্ষিক এমন অনেক উপলক্ষ্যে প্রতিবাদের ক্ষীণ ইচ্ছা থাকলেও কারণবশত করা হয়না।

প্রতিবাদ অক্ষমতার অসংখ্য দুঃসহ অনুষঙ্গ আমার স্মৃতিতে তোলা আছে। যেসব মেমোরিজ আমাকে মাঝেমধ্যেই তীক্ষ্ণ আঘাত দেয়। মনে করিয়ে দেয়, আমার মেরুদণ্ড ঠিক জায়গায় নেই। হয়তো এই ধরণের চিন্তাকে অহেতুক আঁতলামি মনে হতে পারে। কিন্তু, আমার কাছে যেকোন ধরণের প্রতিবাদ-অক্ষমতাই ক্ষমার অযোগ্য। ইচ্ছা করলে হয়তো প্রতিবাদ না করার বা করতে না পারার পেছনে অনেক কারণ হাজির করতে পারবো। কৈফিয়ত তৈরী করতে পারবো। কিন্তু, সেসব অজুহাতে দেয়ার কোন অর্থই হয় না।

আমার ব্যক্তিগত বিচারে যেকোন মানুষকেই একটি সুনির্দিষ্ট পর্যায়ে প্রতিবাদী হতেই হবে। চারপাশে ঘটতে থাকা সব অন্যায়, অনিয়মের বিরুদ্ধেই কথা বলতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে, ব্যপারটা ঠিক সেরকম নয়। কিন্তু, নিজের বিশ্বাস, মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক যেকোন কিছুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা একধরণের জরুরী মানবিক যোগ্যতা। ভিন্নমত থাকতেই পারে। আমি মনে করি, আমাদের মেরুদণ্ড টিকিয়ে রাখার জন্য নিয়মিত প্রতিবাদ করে যাওয়াটা ভীষণ দরকারি।

শৈশব-কৈশোর ও পরবর্তিতে নানা রকম অজুহাতে আমি শিখেছি, নিস্ক্রিয় থাকার বিদ্যা। শিখেছি ঠিক সময়ে কীভাবে নির্বিকার থাকা যায়। এই দীর্ঘ নির্বিকারত্ব আমাকে দিনে দিনে একজন স্পাইনলেস বা মেরুদণ্ডহীন মানুষে পরিণত করেছে। আত্মমর্যাদাবোধ সহ বেঁচে থাকার জন্য যে মানবীয় সাহস, অন্যদের সম্মানের প্রতি শ্রদ্ধা, ভিন্ন মতের প্রতি সহনশীল হওয়া যোগ্যতার , তার প্রায় সবখানেই আমার স্কেল অনেক নীচে। এই নীচে নামতে থাকার বিষয়টি আমি সজ্ঞানেই জানি। জেনেও প্রয়োজনে প্রতিবাদ করতে না পারা, আমাকে ঢ্যাঁড়শে পরিণত করে ফেলেছে।

মানুষ থেকে মেরুদণ্ডহীন কিছুতে পরিণত হতে থাকার জন্য নিজের জন্য আমার দুঃখ হয়। যাদের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে নির্বিকার থেকেছি, তাদের কাছে করজোরে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। একটু আন্তরিকভাবে চাইলেই যেসব অবিচার থামিয়ে দিতে পারতাম, কিন্তু থামাই নি, সেসব অবিচারের শিকার মানুষদের কাছে নতজানু লজ্জায় মাথানত করছি। মাফ করবেন।

স্বজাতির উপর অন্যায় ঘটতে দেখলে, গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা নেড়ি কুকুরও প্রতিবাদ করে। বন্ধুর জন্য, প্রিয়জনদের জন্য প্রতিবাদ করে জীবন দেয়ার নজিরও আছে অনেক। আমি হয়তো এখন আর মানুষই নেই। নিজের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী। অদ্ভূত বিষাদ নিয়ে নির্বিকার কাটিয়ে দিচ্ছি প্রতিবাদ-অক্ষম ঢ্যাঁড়শমার্কা এক জীবন।

Leave a Comment