Hafizul Islam

কইন্যা’র হাসিমুখ আর ছোট্ট মাকানের জন্য ফৌজি জওয়ানের প্রতীক্ষা

পড়েছেন: 13 জন পাঠক

ট্রেনে করে কোলকাতা থেকে ফিরছি বাংলাদেশে। ইন্ডিয়া অংশের বর্ডার গেদে। নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে কোলকাতা থেকে ইন্ডিয়ান রেলওয়ে পুলিশের একটি বিশেষ শাখা আরপিএফ এর একদল সদস্য। বগি থেকে বগিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাদের অনেকে। কখনো দরকার মনে করলে কাউকে হয়তো কিছু জিজ্ঞাসা করছেন। ট্রেন চলছে ঢিমেতালে। আমার পাশের সিটে কোন যাত্রী নেই। ট্রেনের মন্থর গতি আর ঝিকঝিক ঝিকঝিক সুরে ঘুম আসছে।

হঠাৎ আরপিএফের ইউনিফর্ম পরা একজন আমার পাশের সিটে বসলেন। দেখতে শুনতে বেশ সুদর্শন। কাঁধে ঝোলানো বন্দুক নিয়মিত যত্নে চকচক করছে। পরনের ইউনিফর্ম সদ্য আয়রন করা। ছোট করে ছাঁটা গোফ আর আর্মিকাট চুল। দেখতে ঝকঝকে তরুন। আমার পাশে বসাতে আমি একটু তটস্থ হলাম। উনি প্রায় হাসিমুখে না হেসেই বললেন, কোন সমস্যা নেই। আমি যেনো ব্যস্ত না হই।

একটু পর আমার মনোযোগ চলে গেলো ট্রেনের শব্দে। হালকাতালে ঝিমুচ্ছি। বেশ খানিক্ষণ পর আমার মনে হচ্ছিলো, ট্রেন চলছে না কেনো! সজাগ হতেই আবিষ্কার করলাম, ফৌজি জওয়ানের কাঁেধে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম! সর্বনাশ! বিব্রত হয়ে স্যরি বলছিলাম। উনি তখন একটু হাসলেন মনে হলো। বললেন, কৌই বাত নেহি! আমার ঘুম তখন হাওয়া।

বাইরে তখন সকাল শেষ হয়ে দুপুর আসি আসি করছে। রোদের তাপ এসি করা কামরা ঢুকতে পারছে না। তখন ট্রেন নদীয়া জেলা পার হচ্ছে। আমি কতোকিছু ভাবছি বসে বসে। আমার প্রথম বিদেশ ভ্রমণ! প্রথম নিজের দেশের বাইরে পা রাখা। প্রথম পাসপোর্টে ডিপার্চার সিল। প্রায় ৮ দিন আমি বাংলাদেশে ছিলাম না! অবাক কাণ্ড। যদিও কোলকাতা আমাদের একরকম আঙিনা। বিদেশ বললে হয়তো অনেকেই হাসবে। তবুও, আমার জন্য এটা বিদেশই।

বসে বসে এসব ভাবছি। এমন সময় পাশে বসা ফৌজির ফোন বাজলো। ফোন ধরার আগেই খেয়াল করলাম, উনার গম্ভীর মুখটা আমূল বদলে গেছে। ফুল ভোল্টেজের দারুন হাসিতে আলোকিত হয়ে উঠেছে ফৌজি জওয়ানের চেহারা। এমনকি চোখেও লেগেছে আনন্দের ছোঁয়া। কথা বলতে শুরু করলেন। আঞ্চলিক হিন্দিতে বলছিলেন। বেশিরভাগ সংলাপই আমি বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু, খণ্ড খণ্ড আলাপে বেশ বুঝতে পারছিলাম, ফোনের ওপাশে তার স্ত্রীর সাথেই কথা হচ্ছে।

আলাপের এক পর্যায়ে উনি বলছিলেন, কইন্যা কী করছে। মা সম্ভবত ছোট মেয়ের মাটিতে বসে বিভিন্ন জিনিসপত্র ছড়িয়ে খেলার দৃশ্য ভিডিও কলে দেখাচ্ছিলেন। তখন ফৌজি বাবার আনন্দ কে দেখে! শান্ত গম্ভীর অস্ত্রধারী সৈনিকের কোন চিহ্নই যেনো নেই কোথাও। আমাদের ভাষার ব্যবধান, আবেগের ভিন্নতা, ক্রস বর্ডার ট্রেনের অনাকাংখিত টেনশান সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিলো। পাঞ্জাব কিংবা কোলকাতা থেকে দূরের কোন গ্রামের ছোট্ট উঠানে বসে মাটি নিয়ে খেলতে থাকা জওয়ানের আদরের প্রিয় কইন্যা যেনো আমার চির পরিচিত আত্মীয় হয়ে উঠে।

ফোনের স্ক্রীণে বাবার মুখ দেখে তার কইন্যা নিজের অদ্ভূত আধোবোলের শব্দে বাবার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছিলো। বাবা-মেয়ের সেই কথোপকথন পৃথিবীর বহুপ্রাচীন ভাষাগুলোর মধ্যে একটা, যার কোন অনুবাদের দরকার হয় না। সেই ভাষা আমি বুঝে যাই। ভালোবাসার শব্দগুচ্ছ বুঝতে হয়তো যুক্তি ও জ্ঞানের চাইতে হৃদয় ও আবেগের প্রয়োজন বেশি হয়।

মেয়ের কথা চলতে চলতেই ভিডিও কলে ফৌজি জওয়ানের স্ত্রীর সংলাপ ভেসে আসছিলো। বাড়ির পাশে ছোট্ট যে নতুন ঘরটা কেনার কথা ছিলো, সেটা নিয়ে তিনি যেনো মালিকের সাথে পাকাপাকি কথা বলেন। এটি নিয়েই তাগাদা দিচ্ছিলেন জওয়ানের স্ত্রী। তখন ফোজি জওয়ান তাদের নতুন কিনতে চাওয়া ঘর নিয়ে কিছু টুকটাক আলাপ শেষে ফোন রাখলেন। একটু পর সম্ভবত মাকান মালিককে কল দিলেন। কবের মধ্যে টাকা দিতে হবে, আরেকটু দাম কমানো সম্ভব কিনা, সেসব বিষয় নিয়ে আলাপ করছিলেন।

ঘরের পাশে যে উঠানটা আছে, যেখান দিয়ে খোলা মাঠ দেখা যায়, মাকান মালিক আরেকটু বেশি জায়গা বিক্রি করতে পারেন কিনা, আলাপ করছিলেন সেগুলো নিয়ে। কারণ হিসাবে বলছিলেন, তার মেয়ে এখন ছোট। মেয়ের খেলাধুল, ঘুরে বেড়ানোর জায়গা লাগবে। বড় হলে তখন একটু প্রাইভেসির দরকার পড়বে। এখন যেখানে আছেন, বারোয়ারি বাড়িতে স্বাধীনভাবে থাকা কষ্টকর। তাই, এই ছোট মাকানটাকে তিনি মোটামুটি ঠিকঠাক সাজাতে চান।

একদেশ থেকে সীমানা পেরিয়ে অন্যদেশে ছুটতে থাকা ট্রেনের সিটে বসে আমি দেখছি। ট্রেনের ঘষাকাঁচে ঢাকা জানালা দিয়ে দেখছি, ছুটে যাচ্ছে গাছপালা, ঘরবাড়ি। নাই হয়ে যাচ্ছে মানুষ। সরে যাচ্ছে নদীয়া জেলা। দুইটা আলাদা দেশ। আমাদের আন্তর্জাতিক পরিচয় ভিন্ন। পাসপোর্টের রঙ ভিন্ন। ভাষা আলাদা। কিন্তু, এইযে আমার পাশে বসা ফৌজি জওয়ান বাবা, তার সাথে আমার দেশের অনেক বাবার কী দারুন মিল! তাদের নাগরিক পরিচয়ে পার্থক্য থাকলেও আদরের সন্তানের জন্য তাদের ভালোবাসা কেমন একটা সরল রেখায় এসে মিলে যেতে থাকে।

বন্দুকধারী ইউনিফর্ম পরা কড়া চেহারার ফৌজি জওয়ানকে আমার অনেকদিনের পরিচিত মনে হয়। ক্রস বর্ডার ট্রেনের উত্তেজনা, নিরাপত্তার শংকা, সীমান্ত পার হওয়ার টানটান অনুভূতি, বৈরিতার হাওয়া সবকিছু কেমন হাওয়ায় ভেসে যেতে থাকে। দূর গায়ের টুকটুক করে হাঁটতে থাকা প্রিয় ফৌজি কন্যা আমার কাছে দেশকাল সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে অনেক বেশি কাছের মনে হয়।

ভালো থাকুক নাম না-জানা ফৌজি কইন্যা। তাদের বহু প্রতীক্ষিত ছোট্ট মাকানের স্বপ্ন পূরণ হোক।

Leave a Comment