Hafizul Islam

“টাকা জমানোর চেয়ে দ্রুত গতিতে ছড়ায় ক্যান্সার”

পড়েছেন: 61 জন পাঠক

“টাকা জমানোর চেয়ে দ্রুত গতিতে ছড়ায় ক্যান্সার; লেবাননে আমার রোজগারে মাকে বাঁচাতে পারছি না”

লেবাননে, একজন মায়ের ক্যান্সারের চিকিৎসায় প্রতি ৩ সপ্তাহে দরকার ৭ হাজার ডলার। এই অর্থ জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে সন্তান

আপনার টাকার মূল্য কতো? আল জাজিরার এই সিরিজে জীবন-যাপনের খরচ মেটাতে সংকটে থাকা কিছু মানুষের মাসিক খরচের খতিয়ান। এই পর্বের অতিথির নাম শাদি আজার। বয়স ৪০। পেশায় একজন ফ্রিল্যান্স গ্রাফিক ডিজাইনার। একটি ক্যানারি পাখি, পাপায়া নামের একটি লাভবার্ড এবং দুটি ফিঞ্চের সাথে একই বাসায় থাকেন শাদি।

লেবাননের রাজধানী বৈরুত থেকে ঘন্টাখানেকের দূরত্ব জেবিলের। সেখানে একটি ৩ বেডরুমের এপার্টমেন্টে শাদির বসবাস। প্রয়োজনের চেয়ে বেশ বড় তার বাসা। মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ার পর যখন শাদি বাবা-মায়ের কাছাকাছি একই পাড়ায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন এই বাসাটাই খালি ছিলো।

শাদি আজারের মাসিক পারবারিক আয় ১ হাজার ডলার ( হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসাব অনুযায়ী লেবাননে মধ্যম আয়ের পরিবারে মাসিক আয় ১২২ ডলার )। ইউএস ডলার এবং লেবানিজ পাউন্ড ২ ধরণের কারেন্সিতে রোজগার করেন তিনি। লেবাননে এই দুই রকম মুদ্রা সমানভাবে চলে।

চলতি মাসে সবমিলে খরচ ৯৬৯ ডলার। মে মাসে (২০২৩) শাদির বেতনের অর্ধেক খরচ হয়েছে বাসা ভাড়ায়। বাকী টাকা খরচ হয়েছে মা ও তার চিকিৎসা, পরিবারের খাবার-দাবার, যাতায়াত, বিদ্যুৎ, ফোন ও ইন্টারনেট বিল পরিশোধে। প্রতি ৩ সপ্তাহে মায়ের ক্যান্সারের একডোজ ঔষধের জন্য খরচ হয় ৩ হাজার ডলার। এই পরিমাণ অর্থ খরচ করার সাধ্য শাদির নেই।

Freelance graphic designer Chadi Azar hoped his savings would help him buy a home and build a stable future [Tessa Fox/Al Jazeera]
Freelance graphic designer Chadi Azar hoped his savings would help him buy a home and build a stable future [Tessa Fox/Al Jazeera]

১০ বছর ধরে কঠিন পরিশ্রমে কাজ করেছেন ফ্রিল্যান্স গ্রাফিক ডিজাইনার শাদি আজার। একসময় তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমার পরিমাণ দাঁড়ালো ৪০ হাজার ডলারে। পরিকল্পনা করেছিলেন, জমানো টাকায় ছোট্ট একটা বাড়ি কিনবেন। নিজের বাড়ি হলে খানিকটা নিশ্চিত হবে জীবন, এমন আশাই করেছিলেন শাদি।

কিন্তু, ২০১৯ সালে লেবাননের অভিজাত শ্রেণীর শাসকদের কয়েক যুগ ধরে চলমান দূর্নীতি আর অরাজকতার ফলে দেশটির অর্থনীতি ও ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ধ্বস নামে। ডলারের রিজার্ভ শেষ হয়ে যায়। ব্যাংকগুলো ভোক্তাদের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হচ্ছিলো। জমানো ডলারের আসল অর্থমূল্যের বদলে কিছু অংশ করে গ্রাহকদের দিচ্ছিলো ব্যাংকগুলো। তাও আবার লেবানীজ পাউন্ডে। শাদির মতো লক্ষ লক্ষ নাগরিকদের জমানো অর্থ আটকে যায় এসব অর্থনৈতিক গ্যাড়াকলে।

মে মাসের এক বিকেলে শাদির বাসার কাছের একটি ক্যাফেতে বসে আলাপ হচ্ছিলো তার সাথে। টেবিলে দেয়া কফি প্রায় ছুঁয়েই দেখেননি তিনি। সরকার আমাদের কাছ থেকে আমাদের টাকা চুরি করছিলো। ইচ্ছাকৃত অবহেলায় ভুলেই গিয়েছিলো আমাদের কথা। এভাবেই বলছিলেন নিজের অভিজ্ঞতা।

অর্থনৈতিক ধ্বসের বছরই শাদির ৬০ বছর বয়সী মা, হালা’র ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়ে। ৩ হাজার ৫০০ ডলারের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তারা জানতে পারেন, ক্যান্সারটি মায়ের রক্তে ভর করে শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে।

খুব দ্রুতই ক্যান্সারটি তার ফুঁসফুসকে আক্রান্ত করে ফেলে। এই অবস্থায় টার্গেটেড রেডিয়েশন ট্রিটমেন্ট আর মতো চিকিৎসা নিতে হবে মাকে। প্রতিবারে খরচ হবে ৩ হাজার ডলারের মতো। চিকিৎসা শুরুর পর সেটি বেশ কাজে দিলেও এখনো মায়ের রক্তে ক্যান্সারের সেল দিব্যি টিকে আছে।

শাদির মায়ের শরীরে অন্যকোন অঙ্গে ক্যান্সারের আক্রমণ ঠেকাতে নিয়মিত চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই।

Chadi is able to see his parents' home from his apartment block [Tessa Fox/Al Jazeera]
Chadi is able to see his parents’ home from his apartment block [Tessa Fox/Al Jazeera]

ওষুধপত্র নাগালের বাইরে

শাদির ঘরভর্তি গাছ। উইন্ড চাইমের শব্দ ভাসছে বাতাসে। কম্পিউটার স্ক্রিণে দেখা যাচ্ছে পানিতে ছিটকে পড়েছে কসমেটিকসের বোতল। কীভাবে পানির বিন্দু নিয়ে অ্যানিমেশন করা যায়, সেটাই শিখছেন তিনি। নতুন টেকনিক শেখার জন্য কখনো কখনো তাকে রাত ৪ টা পর্যন্ত জেগে থাকতে হয়।

আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কারণে গ্রাফিক ডিজাইনের দুনিয়া খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। প্রতিদিনই নতুন কিছু না কিছু শিখতে হয়। বুঝিয়ে বলছিলেন শাদি। নতুন কিছু শেখা ও কাজ করার জন্য তার আলাদা কোন অনুপ্রেরণার দরকার হয় না। মায়ের ওষুধ ও চিকিৎসার টাকা রোজগারের তাড়না শাদিকে ব্যস্ত রাখে।

হালা’র জন্য বিশেষ ধরণের ওষুধ লিখে দিয়েছে ডাক্তার। প্রতি ৩ সপ্তাহে দরকার হয় ১ ডোজের। যার দাম ৭ হাজার ডলার। শাদির পক্ষে যদি সহজে খরচ মেটানোর সামর্থ্য হতোও, তাও এই ওষুধ লেবাননে নেই। তাকে বিদেশ থেকে আনতে হতো।

বিকল্প হিসাবে শাদির মা হালা, অন্য আরেকটা ওষুধের উপর নির্ভর করেন। আগে সরকার এই ওষুধে ভর্তুকি দিতো। অনেক ক্যান্সারের রোগীর জন্য এখনো ভর্তুকি-সুবিধায় ওষুধ কেনার ব্যবস্থা চালু আছে। কিন্তু, চলমান অর্থনৈতিক দুর্যোগে সরকার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভর্তুকি বন্ধ করে দিয়েছে। হালা’র চিকিৎসাপত্রে সরাসরি এই ওষুধের নাম উল্লেখ না থাকায় তাকে আসল দামেই ওষুধটি কিনতে হবে।

ওষুধটির বাজার মূল্য ২৯ কোটি লেবানিজ পাউন্ড। ( ব্ল্যাক মার্কেটে দাম পড়ে ৩ হাজার ডলার। ) শাদির মাসিক আয় ১ হাজার ডলারের মতো। কখনো বেশি আবার কখনো কম। এই অবস্থায় তার বেতনে মায়ের চিকিৎসার খরচ বহন করা অসম্ভব। আর, শাদির পরিবার কষ্টেসৃষ্টে নিজেরা টিকে থাকলেও তাদের পক্ষে চিকিৎসায় সাহায্য করা সম্ভব না। ফলে, বিষণ্নতা এখন শাদির নিত্যসঙ্গী হয়ে গেছে।

বাসার বারান্দায় বসে কথা বলছিলেন শাদি। নিজের অবস্থা বুঝাতে গিয়ে বলছিলেন, সেপ্টেম্বরে আমি একরকম পাগলই হয়ে গিয়েছিলাম। মায়ের চিকিৎসা চালিয়ে নিতে না পারার বিষয়টি আর সহ্য করতে পারছিলাম না।

কিন্তু, যদি তিনি চিকিৎসার খরচ বহনে সক্ষমও হতেন, দরকারী ওষুধটি সবসময় হাসপাতালে পাওয়া যায় না। মায়ের অনেকগুলো ওষুধের ডোজ বাদ পড়ে গেছে। বিষণ্নমনে জানালেন শাদি।

Chadi’s parents Sabah and Hala [Tessa Fox/Al Jazeera]
Chadi’s parents Sabah and Hala [Tessa Fox/Al Jazeera]

‘মা সবসময়ই ইতিবাচক থাকেন’

শাদির মাসিক আয়ে বাসাভাড়া, খাবার ও দরকারী খরচ চলে যায়। লেবাননে ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করে। হয়তো তিনি তাদের চেয়ে খানিকটা ভালো আছেন। কিন্তু, তিনি বলছিলেন, তার এই আয়ে মাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না।

শাদি বলছিলেন, মাসে ১ হাজার ডলার রোজগার করলে এখানে বেশ ভালোভাবে জীবন চলে যাবে। কিন্তু, খোদার কসম, যদি আপনার প্রিয় কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে আর তাকে জীবিত রাখতে হলে মাসে ৭ হাজার ডলার খরচ হয়, তাহলে এটি আপনাকে মানসিকভাবে ধ্বংস করে দেবে।

যখন পরিবারের কারো চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, তখন সরকারের সেটা নিশ্চিত করার কথা। সরকার যদি না করে, তাহলে যে কারো জন্যই বিষয়টা কঠিন হয়ে পড়ে। চিকিৎসার মতো জরুরী খাতে সরকারের উচিত ভর্তুকি দেয়া। শাদি এমনটাই মনে করেন।

সাগরের পাশেই থাকেন শাদি। দিনে কাজের মধ্যে ডুবে থাকলেই কেবল খানিকটা স্বস্তি পান তিনি।

শাদির বারান্দা থেকে বাবা-মায়ের বাড়ি দেখা যায়। তার বাবা সাবাহ একসময় জেলে ছিলেন। ঘরে থাকা নোঙরের প্রতিকৃতি, বয়াম ভর্তি শামুক-ঝিনুক আর সাগরের খুব কাছেই অবস্থিত বাড়ি, জেলে বাবার অতীতের চিহ্ন বহন করছে।

A corner of the balcony of Chadi's parents' apartment contains objects and photos from Sabah's time as a fisherman [Tessa Fox/Al Jazeera]
A corner of the balcony of Chadi’s parents’ apartment contains objects and photos from Sabah’s time as a fisherman [Tessa Fox/Al Jazeera]

শাদির মা হালাও তার ৬৩ বছর বয়সী স্বামীর মতো সমুদ্রকে ভালোবাসেন। কিন্তু, শারীরিক অবস্থার কারণে এখন আর তিনি সাঁতড়াতে পারেন না। শাদি বলছিলেন, জীবনের প্রতি তার মায়ের বিশ্বাস এখনো মাকে তরতাজা রাখে।  মায়ের প্রয়োজনীয় ওষুধ জোগাড় করতে পারলেই কেবল তার নিজের স্বস্তি হয়। আর কিছু না।

‘জানলে মা খুব দুঃখ পাবেন’

শাদির মা হালা সপ্তাহের বেশিরভাগ দিন বাড়ির কাছের চার্চের পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতায় সময় কাটান। সেজন্য কোন পারিশ্রমিক পান না তিনি। কিন্তু, চার্চে কোন বিয়ের অনুষ্ঠান থাকলে তখন ঝাড়ামোছার জন্য ৬০ ডলার উপার্জন হয়। স্বামী সাবাহ স্থানীয় একটি ফার্ণিচারের দোকানে সপ্তাহে সাত দিন নাইটগার্ডের কাজ করেন। মাসে রোজগার হয় ২০০ ডলার।

বাবা তার রোজগারের টাকা যাতে আলাদা করে রাখতে পারেন এবং নিজের মানসিক নিরাপত্তা বোধের জন্য টাকা জমাতে পারেন,  সেটা নিশ্চিত করার চেষ্টা আমি করি। জরুরী অবস্থায় যেনো তিনি দরকার মতো সেই টাকা খরচ করতে পারেন।

২০১৯ সালে যখন অর্থনৈতিক ধ্বস শুরু হয়, তখন কেউ বিশ্বাস করেনি যে, অবস্থা কখনো এমন খারাপ হতে পারে। কিন্তু, এই বছর মে মাসের শুরুতে প্রতি ডলারের দাম দাঁড়ায় লেবানিজ পাউন্ডে ১ লাখ ৩০ হাজার। গত বছরও প্রতি ডলারের মূল্য ছিলো ২৬ হাজার ৮৫০ থেকে ৩৫ হাজার ৬৯০ লেবানিজ পাউন্ড। ধ্বস শুরুর আগে তখনকার মূল্যস্ফীতিও জনসাধারণের জন্য ভয়াবহই ছিলো।

অনেকে পরিস্থিতি সামলাতে নিজেরা আইন হাতে তুলে নিয়েছিলো। অস্ত্র নিয়ে ব্যাংকে ঢুকে পাওনা টাকার জন্য কর্মকর্তাদের হুমকি দিয়েছিলো। তাদের এমন আচরণের পেছনে যে কোণঠাসা মনোভাব কাজ করছে, শাদি সেটা বুঝতে পারেন বলে জানালেন।

যখন আপনার দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় এবং চারপাশে অহরহ অনায্য বিষয় ঘটতে দেখেন, তখন আপনি নিজেকে সামলাতে পারবেন না। টিকে থাকার জন্য আপনি তখন যেকোন কিছুই করতে পারেন।

কিন্তু, আমি হাতে বন্দুক নিয়ে নিজের টাকা উদ্ধারে যেতে পারি না। আমাকে অনেক কিছু ভাবতে হয়। যদি আমাকে জেলে যেতে হয় আর আমার জন্য কেউ এগিয়ে না আসে, তখন আমি আমার মায়ের জন্য অনেক বেশি জটিলতা তৈরী করে ফেলবো। তিনি জানলে ভীষণ দুঃখ পাবেন।

[Muaz Kory/Al Jazeera]
[Muaz Kory/Al Jazeera]


১ মাসে সংসারের খরচ

ক্যান্সারের ওষুধপত্র

জীবনযাপনের খরচ ও বাবা-মায়ের পরিবারে সহযোগিতার পর, কখনো মায়ের মাসিক চিকিৎসার জন্য শাদির হাতে ১০০ থেকে ২০০ ডলার থাকে। টাকা জমানোর গতির চেয়ে ক্যান্সার দ্রুত ছড়ায়, বিমর্ষ চেহারা নিয়ে বলছিলেন তিনি।

তুরষ্ক থেকে কীভাবে তুলনামূলক সস্তায় ওষুধ আনা যায়, সেটা নিয়ে খোঁজখবর করছিলেন শাদি। কিন্তু, নকল ঔষধের আশংকার বিষয়টিও তাকে ভাবাচ্ছে।

এপ্রিলে একজন পরোপকারী ডাক্তারের মাধ্যমে মায়ের একবাক্স ওষুধের ব্যবস্থা করেছিলেন শাদি। নিজের জমানো টাকা থেকে সেটার দামও পরিশোধ করেছিলেন। কিন্তু, মে মাসের ২৪ তারিখে যখন আবার ওষুধের দরকার, তখন তার কাছে কোন টাকাই ছিলো না।

মায়ের ডাক্তার বলেছিলেন, যদি তুমি তোমার মাকে এমন অনিয়মিত ওষুধ দিতে থাকো, তাহলে হয়তো সামনে আর এটা কার্যকর নাও হতে পারে।  যখন মা নিয়মিত ওষুধ নিতেন তখন তার ক্যান্সার কমে আসছিলো। এমন রোগীদের ক্ষেত্রে ভর্তুকী সহায়তা বন্ধ ও ওষুধের ব্যবস্থা না করা সরকারের অপরাধ।

চলতি বছরের শুরুতে মায়ের চিকিৎসার জন্য ১ লাখ ৪০ হাজার ডলার সংগ্রহের জন্য ক্রাউডফান্ডিং ক্যাম্পেইন শুরু করেছিলেন শাদি আজার। এই টাকায় মায়ের জন্য ২০ ডোজ ওষুধের ব্যবস্থা হতো। আগামী দেড় বছর আর চিন্তা করতে হতো না।

আমার মনে হচ্ছিলো, নিজের চিকিৎসার জন্য অন্যদের কাছে টাকা চাওয়া কিংবা ওষুধ খোঁজার বিষয়টি নিয়ে মা লজ্জিত। কিন্তু, আমার আর কিছু করার নেই। আপনি বলতে পারেন, জাহাজ ডুবে যাওয়ার আগে আমি মরিয়া হয়ে সাহায্য চাইছি। আমার মায়ের জন্য ওষুধের ব্যবস্থা আমাকে করতেই হবে।

মে ২০২২: ওষুধের জন্য কোন টাকা খরচ হতো না। ( সরকারের পক্ষ থেকে ভর্তুকী হিসাবে ক্যান্সার আক্রান্তরা ফ্রিতে এই ওষুধ পেতো।)
মে ২০২৩: এক ডোজের ওষুধের দাম পড়ছে ৩ হাজার ডলার। (২৯ কোটি লেবানিজ পাউন্ড)

The view of the sea on a cloudy day from Chadi's rented apartment [Tessa Fox/Al Jazeera]
The view of the sea on a cloudy day from Chadi’s rented apartment [Tessa Fox/Al Jazeera]

আবাসন খরচ/বাসা ভাড়া

মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ার পড়ে শাদি তার বাসা পাল্টে একই পাড়ায় চলে আসেন। দরকার পড়লে যাতে মাকে সব ধরণের সাহায্য করতে পারেন। এর আগে তার বাসা থেকে মায়ের বাড়ির দূরত্ব ছিলো ৪০ মিনিটের।

সাগর থেকে ১০ মিনিটের ড্রাইভ। এমন দূরত্বে শাদির বর্তমান এপার্টমেন্ট। দেয়ালে পেইন্টিং, বিভিন্ন ধরণের গাছে ভর্তি সুন্দর ও শান্তিময় বাসা। বলছিলেন, আমি গাছ খুব পছন্দ করি। বারান্দায় লাগানো বড় একটি গাছ দেখিয়ে জানালেন, এই মন্সটেরা গাছটি আমি রাস্তা থেকে কেটে এনেছিলাম।

A corner of Chadi's apartment [Tessa Fox/Al Jazeera]
A corner of Chadi’s apartment [Tessa Fox/Al Jazeera]

বাসার জন্য চারশ’ ডলার মাসিক ভাড়া গুনতে হয়। নিজের রোজগারের প্রায় অর্ধেকই চলে যায় বাসা ভাড়ায়। বিষয়টি কষ্টকর হলেও বাবা-মায়ের কাছাকাছি থাকতে পারছেন। তাই, টাকার কষ্টটা গায়ে লাগে না।

নিজের মায়ের চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে না পারলেও নিজেকে অর্থনৈতিকভাবে অন্যদের চেয়ে ভাগ্যবান মনে করেন শাদি। লেবাননের চল্লিশ শতাংশের বেশি পরিবারের মাসিক আয় ১০০ ডলার কিংবা এরও কম।

মে ২০২২: ৪০০ ডলার (১২ মিলিয়ন লেবানিজ পাউন্ড, ব্ল্যাক মার্কেট রেট অনুযায়ী। তখন প্রতি ডলারের মূল্য ছিলো ৩০ হাজার লেবানিজ পাউন্ড)
মে ২০২৩: ৪০০ ডলার (৪০ মিলিয়ন লেবানিজ পাউন্ড)

খাবার

২০১৯ সালের ধ্বসের পর থেকে লেবানিজ পাউন্ড ও ডলারের দামে অস্থিরতার কারণে খাবারের দাম প্রায় প্রতিদিনই উঠানামা করতো। বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার জন্য এই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে সরকার খাবারের দাম ডলারে নির্ধারণ করে দেয়।  অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাহ্যিকভাবে স্থিতিশীল হয়।

শাদি ও তার মতো লেবাননের বেশিরভাগ মানুষ লেবানিজ পাউন্ডে জিনিসপত্র কেনেন। তাই কালোবাজারের রেট অনুসারেই তাদের মূল্য পরিশোধ করতে হয়। সরকারি রেট কোন কাজে আসে না।

লেবাননে খাদ্যবাজারে মূল্যস্ফীতি এখনো অনেক বেশি। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে এপ্রিল ২০২৩ এ, ১১৩ শতাংশের আশেপাশে আছে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে এর পরিমাণ ৪৬০ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছিলো।

খাবারের এতো বেশি দাম হওয়ার পরেও শাদি তার বাবা-মা ও নিজের জন্য অস্বাস্থ্যকর খাবার কিনতে নারাজ। আমি অস্বাস্থ্যকর খাবার কিনতে চাই না। ক্যান ফুড কিংবা বয়ামজাত খাবার সস্তা হলেও আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভবিষ্যতে অনেক ক্ষতির কারণ হবে। আমি চেষ্টা করি যতোটা সম্ভব স্বাস্থ্যকর উপায়ে বেঁচে থাকার।

শাদির বাবা মাঝে মধ্যেই কমদামী ও অস্বাস্থ্যকর খাবার কিনে আনেন। যেমন মাখন বা বাটারের পরিবর্তে মার্গারিন। আমি বাবাকে এসব কিনতে নিষেধ করি। সম্ভব হলে পাল্টে আনি। মার্গারিনে কলেস্টরেল আর হাইড্রোজেনেট ওয়েল থাকে।

স্বাস্থ্যকর খাবার খেলেও শাদির জন্য খাদ্য কখনো ভোগের বিষয় ছিলো না। জীবনে একমাত্র বিলাসিতা হিসাবে আমি শান্তিতে ঘুমাতে চাই। আর, ভাবতে চাই মা ভালো আছেন।

শাদি তার বাবা-মায়ের সাথে খাবার যেমন ভাগাভাগি করে খান। তেমনই রান্নাও করেন ভাগ করেই। তার চেষ্টা থাকে, যাতে বাবা-মায়ের ফ্রিজ সবসময় খাবারে ভরা থাকে।

মে ২০২২: ৯ মিলিয়ন লেবানিজ পাউন্ড (৩০০ ডলার) লাগতো শাদির পরিবারের গ্রোসারিজ বা মুদিপন্যের জন্য
মে ২০২৩: ৩০ মিলিয়ন লেবানিজ পাউন্ড (৩০০ ডলার) খরচ হয় একই পরিমাণ পন্যের জন্য

মায়ের ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরুর পর থেকে নিয়মিত মাইগ্রেনের ব্যথায় ভুগছেন শাদি আজার। দৈনন্দিন কাজকর্ম ঠিকঠাক করার জন্যও তাকে মাইগ্রেনের ওষুধ খেতে হয়।

মে ২০২২: ১.৫ মিলিয়ন পাউন্ড (৫০ ডলার) খরচ হতো মাইগ্রেনের ওষুধের জন্য
মে ২০২৩: ৫ মিলিয়ন পাউন্ড (৫০ ডলার) খরচ হয় একই ওষুধ কিনতে

*গত বছরের খরচের হিসাব শাদির মাধ্যমে নেয়া
**প্রতিবেদনে ব্যবহৃত রেট কালোবাজারের হিসাবে করা হয়েছে। লেবাননে ব্ল্যাক মার্কেট অনুযায়ী জিনিসপত্রের দাম হিসাব করা হয়

Leave a Comment