Hafizul Islam

সংবাদের জমিন বিক্রির ডিজিট-আল ফান্ডা

পড়েছেন: 27 জন পাঠক

পেশায় সংবাদকর্মী বললেও আমি মূলত সংবাদ বেচে খাই। দিনরাত শিফট-ডিউটি রোস্টারের চক্করে ঘুরতে ঘুরতে যেসব নিউজ তৈরি করি, সেটার লক্ষ্য সংবাদের লক্ষ্যের চাইতেও গুরুতর। দুই চারটা পয়সা কামানো।

জন্মলগ্ন থেকে সংবাদ মাধ্যম অথবা গণমাধ্যম আয়-রোজগারের টুলস ছিলো না। কিন্তু, সময়ের সাথে পাল্টেছে ধরণ। তৈরি হয়েছে উপযোগিতা।

সংবাদ বিক্রি মোটেও মন্দ কিছু না। বরং, সংবাদ একইসাথে যেমন জানানো, আনন্দ দেয়ার মতো দায়িত্ব পালন করে। তেমনই মেটায় সংবাদ উৎপাদকের প্রয়োজন ও নানাবিধ চাহিদা। কখনো সেটা হতে পারে অর্থনৈতিক আবার কখনো ক্ষমতা কিংবা সামাজিক স্বীকৃতি। সংবাদের বিনিময়ে লাভজনক অনুষঙ্গ- এমন হওয়াও দোষের কিছু না। বরং, সংবাদকর্মী হিসাবে আমিও চাই, আমার সংবাদের বিক্রি বাড়ুক।

যেহেতু আমি মেনেই নিচ্ছি সংবাদ একটি বিশেষ রকমের দ্রুত পচনশীল পন্য, তাহলে, সেটা বেচায় সমস্যা কোথায়? ঝামেলার শুরু কখন হয়েছে, সেটা এক কথায় বলা মুশকিল। সময়ের সাথে সাথে সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যম, ধরণ, পদ্ধতি পাল্টেছে। বাজারের বারোয়ারি ফরমান টানানোর বোর্ড থেকে ছাপা পত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশনের নানা ফরম্যাট পেরিয়ে আজকের ডিজিটাল মিডিয়া।

মাধ্যম পাল্টানোর সাথে সাথে বদলে যেতে থেকেছে সংবাদের চরিত্র। টিকে থাকার জন্য আবিস্কার করতে হয়েছে সংবাদ বেচার নতুন নতুন পদ্ধতি। বর্তমানে সংবাদের ভোক্তাদের বেশিরভাগ অংশ সংবাদের জন্য নির্ভর করেন ফেসবুক, ইউটিউবের মতো বিভিন্ন স্যোশ্যাল প্ল্যাটফর্মের উপর। ব্যবহার ফ্রি এসব প্ল্যাটফর্মে একজন ব্যবহারকারীই মূলত পণ্য। সেখান থেকে তিনি যে সংবাদ আহরণ করেন, সেটাও পণ্য।

স্যোশাল প্ল্যাটফর্মগুলোর মূল আয় আসে বিজ্ঞাপন থেকে, এটাতো আমরা জানি। এই বিজ্ঞাপন দেখানোর জন্য প্ল্যাটফর্মগুলোর দরকার হয় কনটেন্ট। যতো বেশি আর ইউনিক কনটেন্ট, ততো বেশি ভোক্তার আগমন। ততোই বেশি বিজ্ঞাপন দেখিয়ে আয় করার সুযোগ।

কনটেন্ট জোগাড় করা সহজ না। স্যোশ্যাল প্ল্যাটফর্মগুলো এই সমস্যার সমাধানে আনলো মনিটাইজেশন বা ইনকাম করার একটি পদ্ধতি। যতো বেশি কনটেন্ট আপলোড করবে একজন ব্যবহারকারী, শর্তসাপেক্ষে প্রতিটি কনটেন্টের জন্য তাকে দেয়া হবে টাকার ভাগ। ব্যস, কনটেন্ট বানানো আর আপলোডের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো সবাই। এই ভিড়ের মধ্যে ছিলো র’ম্যাটারিয়ালের ভাণ্ডার নিয়ে বসে থাকা সংবাদমাধ্যমগুলো।

ডিজিটাল মিডিয়া বা নিউ মিডিয়ার যুগ হওয়ার সুবাদে সংবাদ এখন অনেক বেশি ডিভাইস-নির্ভর। নির্দিষ্ট করে বললে, মুঠোফোন নির্ভর। সংবাদের এই ট্রান্সফর্ম চলাকালীন আমাদের মতো সংবাদ ব্যবসায়ীরা শুরু করলাম অডিও-ভিজুয়াল সংবাদ বিক্রি।

ভিডিওর মাঝখানে ১০ সেকেন্ডের পপআপ, ডানে বায়ে লোগোর মতো দেখতে ডগি নামের এড, কখনো আবার সংবাদ চলতে চলতে হঠাৎ ওভিসি। এই বিজ্ঞাপনগুলো থেকে আসা আয়, সংবাদ হাউজগুলোর নিয়মিত তহবিলে যায়। আর, স্যোশ্যাল মিডিয়ায় সেই একই কনটেন্ট আপলোড করে, মনিটাইজেশন পলিসি’র কল্যাণে দ্বীতিয়বারের মতো মোটা অংকের টাকা আয় করা যাচ্ছে।

এখানেই আসে সংবাদকর্মীদের দায়ের বিষয়। বিজ্ঞাপনের স্পট বিক্রি করতে গিয়ে আমরা বেচে দিচ্ছি আমাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, সাংবাদিক হিসাবে নিজস্ব অনুভব, স্বাধীকারসহ সবকিছু। উদাহরণ হিসাবে সংবাদের অ্যাডভার্টাইজিং স্পট বা বিজ্ঞাপন জমিনের কয়েকটি ছবি নিয়েছি।

লাল মার্ক করা অংশগুলো দেখুন। তারপর সংবাদের মূল ভাষ্যটি পড়ুন। এবার নজর দিন প্রতিটি ইমেজের নীচে সাটানো বিজ্ঞাপনের দিকে। গৃহবধূর দুঃখজনক মৃত্যুর সংবাদের নীচে ৬ গুন বেশি ফ্রেশনেস, বঙ্গবাজারে আগুনে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ীদের পোড়া কপালের নীচে দাগহীন উজ্জ্বলতা, বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির নীচে বেশি ফ্রেশনেসের হাসিমুখের মডেল ও অনুপমের স্ত্রীকে ট্রলের আলাপের নীচে আনলিমিডিটেড লাইফের হাতছানি!

আহা! বিজ্ঞাপনের কী নিদারুণ ব্যবহার! এই জাতীয় পোস্টগুলো ফটোকার্ড, ফটোপোস্ট, ইনফোকার্ডসহ প্রতিষ্ঠানভেদে বিভিন্ন নামে পরিচিত। ব্র্যান্ডগুলো নির্ধারিত সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছানো/ইম্প্রেশন/রিঅ্যাকশনের টার্গেট দিয়ে থাকে। আমাদের মতো যারা এই কার্ডগুলো তৈরি করি, কোটা পূরণের চাপ থাকায় আমাদের পক্ষে প্রায়সময়ই বাছবিচারের সুযোগ থাকে না। ফলে, সৃষ্টি হয় এমন অনাসৃষ্টি।

এমন শুধু স্থিরচিত্রের বিজ্ঞাপনে হয়, বিষয়টা সেরকম না। ফুটেজ, তৈরি সংবাদ প্যাকেজ, আনকাটসহ বিভিন্ন ধরণের ভিডিও কনেটেন্টেও এরকম ব্যপার ঘটে। ব্র্যান্ডিয়ের কারণে জটিল সংবাদ হয়ে যায় খেলো। শোকের সংবাদ হয়ে যায় আনলিমিটেড লাইফের গল্প।

আমার কিংবা সংবাদ ফুড চেইনের তলানীতে বাস করা আমাদের শ্রেণীর সংবাদকর্মীদের খুব একটা করার কিছু থাকে না। আমরা চাপে পড়ে এরকম ঘটাই। এমন অজুহাতে আমরা পার পেয়ে যাই। আমাদের এই অজুহাত মোটেও মিথ্যা না। বেশিরভাগ মিডিয়াগুলো প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম সংখ্যক লোকবল নিয়ে চলে। মান ধরে রাখতে গেলে মানি আসবে না।

সংবাদ মাধ্যম কিংবা নিউজ কনটেন্ট বেচাবিক্রি এখন অনেক জটিল। আয়-রোজগারের চ্যানেল বা মাধ্যম যেমন বেড়েছে, তেমনই বেড়েছে কনটেন্টের বহুমুখী ব্যবহারের তাগাদা। দ্রুত পরিবর্তনশীল সংবাদের অর্থনীতি, টিকে থাকা, ভিউয়ারশিপের চক্কর ও মানসম্পন্ন সংবাদ তৈরির গ্যাড়াকলে পড়ে সংবাদকর্মীদের দম ফেলার ফুরসৎ মেলে না। হয়তো খানিকটা অবহেলাও যোগ হয় কখনো।

সবকিছুর পরেও সংবাদপত্রের জমিন, নিউজ প্যাকেজের ফ্রেম, ফটোকার্ডের পিক্সেল যদি কৌতুক ও ভাড়ামোর জায়গা হয়ে উঠার এই অধঃপতন, আখেরে মঙ্গলজনক হবে বলে আমার মনে হয় না। ব্র্যান্ডগুলোও একসময় এসব যাচাই করতে শুরু করবে। তখন ব্র্যান্ডিংকে বান্দ্রামি কিংবা বাঁদরামো হিসাবে দেখানোর সুযোগ বন্ধ হবে। টান পড়বে রোজগারের ভাণ্ডে।

আমার মতো সংবাদ বেচেই যাদের পাতে খাবার উঠে, আমাদের উচিত নিজের জায়গা থেকে সাধ্যমতো খানিকটা সচেতন হওয়া। গতিশীলতার মাধ্যম হওয়ার শত বিপত্তির পরেও নিউজ স্টোরি, নিউজ কনটেন্ট যেনো খুব হাস্যকর কিছু না হয়ে যায়।

 

 

Leave a Comment