এখন সকাল ৫.১০। বড়ো’পার হাকডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ‘‘এ্যাই! তুই এখনো ঘুমোচ্ছিস? আশ্চর্য!!! আজকে না আমাদের বেড়াতে যাবার কথা! দেখ দেখ, বাইরে কি সুন্দর সকাল! ’’ আপি জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিলেন।
ঝলমলে আলোর বন্যা ভাসিয়ে নিয়ে গেলো রাতভর ঘাপটি মেরে অঘোরে ঘুমোনো জমাট অন্ধকার। নতুন সূর্যরশ্মির প্রতিটি আলোকবিন্দু ফোটায় ফোটায় ঝরছে আমার জানালার ফলস সিলিং থেকে। কি অদ্ভূত রকম সুন্দর চারদিক!
আমি রনি। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ঘিঞ্জি আর সস্তা একটি এলাকায় আমার নিবাস। ছোট্ট একটি রুম। তারচেয়ে অনেক ছোট একটি জানালা। শত চেষ্টায়ও এই চারকোনা গরাদ আঁটা জানালা দিয়ে আকাশের দেখা মেলে না। আর এখন আমি স্বপ্নের দেশ আমেরিকায়। বড়ো আপির বাসায় থেকে আমেরিকা দেখবো। আমার আপি এখানেই থাকেন। ছোট্ট একটি রাজকন্যাকে নিয়ে তার সংসার। তাড়াহুড়ো করে নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়লাম আপির তেল চকচকে গাড়ি নিয়ে। কে জানে, এর লালন-পালন বাবদ খরচ কতো পড়ে!
আপি ড্রাইভ করছে। এমপিথ্রি প্লেয়ারটা গাইছে ধীর আর অন্তর্লীন কন্ঠে। এমনি করে..যায় যদি দিন..যাক না..।
হু হু করে বাতাস বইছে। আপির চুল উড়ছে কখনো। কখনো লুটিয়ে পড়ছে কপালে। মুখে। পাশে বসে আমি দেখছি নীরবে। কল্পনার ডানায় চড়ে ফিরে গেছি বহু বছর পূর্বে। বাংলাদেশের আর দশটা গ্রামের মতোই খুব সাধারণ একটি গ্রাম। সেই গ্রামের একটি বাড়ির আঙিনায় ফ্রক পড়া ছোট্ট একটি মেয়ে সাতচারা খেলছে। চুলগুলো ঘামে ভিজে লেপ্টে আছে তার লালচে গাল, গলা, মুখে। আপিটা এখনও সেই আগের মতোই আছে। মানুষ আসলে কখনোই হয়তো পুরোপুরি বদলে যায় না। কিংবা চাইলেও নিজেকে আমরা সম্পূর্ণ অন্য আমিতে পরিবর্তিত করতে পারি না। অজান্তেই বিভিন্ন সময়ে ফিরে যাই আমাদের অতীতে। আমার পাশে বসে আনমনে খেলছে আমার ভাগ্নি। দারুন মায়াকাড়া চেহাড়া। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। মাকে সচারচর খুব একটা কাছে পায় নাতো। তাই মায়ের প্রতি ওর দারুণ টান। আমরা এখন এতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছি! যেখানেই তাকাও তুমি, দেখবে শুধু কর্মব্যস্ত মানুষের অবিশ্রান্ত ছুটে চলা। ইট-কাঠ-পাথরের যান্ত্রিক শহর পেরিয়েছি একটু আগে। সামনে নয়নাভিরাম হাইওয়ে। দিগন্ত ছোঁয়ার অভিযাত্রায় সোজা এগিয়ে গেছে সামনে। আমাদের গাড়িটা চলছে সমুদ্রের কোল ঘেষে। এতো সুন্দর আশপাশ!
সমুদ্র দেখতে দেখতে আমরা এখন পৌছে গেছি আপন গন্তব্যে। আপির বাসা থেকে প্রায় ৭০ মাইল দূরত্ব। খুব সুন্দর একটা সমুদ্রসৈকত।
প্রতি উইকএন্ডে আপি তার রাজকন্যাকে নিয়ে চলেন আসেন সমুদ্রের কাছে। সমুদ্র দেখতে আসেন তিনি? নাকি, নিজের মধ্যে জমে থাকা সমুদ্রের মতো সুবিশাল কষ্টরাশি বুকে নিয়েও কিভাবে হাসতে হয়, তার মহড়া দিতে আসেন? প্রচন্ড দুঃখে কি করে হাসতে হয় হা হা করে, শিখতে আসেন এই ঐশ্বরিক ঔদার্যময় সমুদ্রের কাছ থেকে!
গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা আমাদের রিসোর্ট চত্ত্বরেই। দারুন লাগছে চারপাশ!
চটজলদি ফ্রেশ হয়ে তৈরী হয়ে নিলাম বীচে যাওয়ার জন্য। রিসোর্ট থেকে বীচে যাওয়ার একটা সুন্দর বাঁধানো রাস্তা আছে। সে পথেই যাবো আমরা। জীবনের সব বাঁকগুলোতে যদি এমন করে পথ চিহ্নিত করা থাকতো!
সামনে বিশাল সমুদ্র। অসংখ্য দর্শনার্থী স্নানানন্দে মেতে উঠেছে। কেউবা আবার সূর্যস্নান করতে ব্যস্ত। আমি আমার দেশের একমাত্র বীচের কথা স্মরণ করি। যদি আমরা সঠিক পরিচর্যা আর প্রয়োজনীয় যত্ন নিতে পারতাম, তাহলে হয়তো এর চেয়েও কক্সবাজারকে অনেক সুন্দর লাগতো।
সুনীল আকাশের কোলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে অতলান্ত সমুদ্র। কি অপূর্ব এক মিতালী!
বিস্তীর্ন তটরেখা। আকাশের নীলিমায় উড়ছে একটি অ-স্বাধীন (!!) পাখিঘুড়ি।
হাঁটতে হাঁটতে আবারো আনন্দকোলাহল। জলকেলী।
ব্যস্ত সমুদ্রতীর
আকাশ আর সাগরের এক বিন্দুতে মিলিয়ে যাওয়ার কি প্রাণান্ত চেষ্টা! মাঝখানে উপদ্রবের মতো কিছু মানুষ ঢুকে পড়ে ক্যামেরার লেন্সে। না হলে হয়তো আরো সুন্দর লাগতো! কিংবা অসুন্দর!!!
আকাশ আর সাগরের নীল কি এক উৎস থেকে উৎসারিত? প্রশ্ন থেকেই যায়। উত্তর কি আদৌ কখনো পাবো? নাকি কোন প্রয়োজনই নেই?
ধূ ধূ তটরেখা হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে গোটা এলাকা জুড়ে।
ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমরা। তাই এখন একটু চা-টা খাওয়া। বিশ্রাম।
বিকাল হয়ে আসছে। আকাশে মেঘেদের লুকোচুরি খেলা। নিঃসঙ্গ একা বাড়ি ফিরছে একটি নাম না জানা পাখি।
রোদছাঁয়ার উৎসব আর তারমাঝে বীচে বসে আছে একঝাক পায়রা। দূরে হাঁটতে হাঁটতে বিন্দুর মতো মিলিয়ে যাচ্ছে একজন একাকী মানুষ।
দলবাঁধা পায়রা এবং একজন নিঃসঙ্গ মানুষ
একাকী একজন সার্ফিং করতে নেমে যাচ্ছে সমুদ্রে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় সার্ফিং করতে। সে’টা আর করা হয়ে উঠে না।
অশান্ত সমুদ্র। কি দারুন একেকটা ঢেউ!!! স্পর্ধা কিংবা অভিমানে আকাশ ছুঁয়ে দিতে চায় যেনো।
মেঘ জমছে আবার। তুলোট মেঘ, সিঁদুরে মেঘ, ছেড়া মেঘ, ইত্যাদি নানা রকমের মেঘ। এবার বৃষ্টি নামবে কি?
ছোটবেলাকার ছোট্ট কবিতা মনে পড়ছে। মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি। আজ আমাদের ছুটি ও ভাই….আজ আমাদের ছুটি।
ফেরার সময় হয়ে এলো বলে। সেই পূর্বের রাস্তা দিয়েই ফিরছি আমরা।
যেতে যেতে দেখছি অস্তগামী সূর্যের ক্ষয়াটে আলোর বিকিরণ।
দিনমনি অস্তপ্রায়। রাঙা আবির ছড়িয়ে দগ্ধ সূর্য ঘুমিয়ে পড়তে যাচ্ছে নতুন আরেকটি আলোকজ্জ্বল সুন্দর দিবসের প্রতিক্ষায়।
আজকে মনে হয় পূর্ণিমা। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় নরোম লাগছে চরাচর। রুপোলি জ্যোৎস্নার অঝোরধারা ঘুম পাড়ানিয়া গান শুনাচ্ছে কর্মক্লান্ত পৃথিবীকে। গাড়ি থামিয়ে দেখে নিচ্ছি ছোটবেলার চাঁদমামাকে।
আমাদের আনন্দভ্রমণ শেষ হয়। কিন্ত, ভালো লাগার রেশটা ঠিক রয়ে যায় অমলিন। স্মরণীয়। আমি ভীষণ রকমের একাকী একজন মানুষ। আমার কল্পনা করতে ভালো লাগে। তাই কল্পনার ঘোড়া ছুটিয়ে বেড়াই অনন্তর। উপরোক্ত ভ্রমণটাও হয়েছে আমার কল্পনার রাজ্যে। আমার একজন বড়ো আপি আছে। থাকেন দূর পরবাসে। তার কথা সারাক্ষণ খুব মনে পড়ে। তিনি ভীষণ ব্যস্ত। তার একটু স্নেহের জন্য আমার এই আকুলতা কখনো তাকে স্পর্শ করে কি? আমার ভাগ্য সবাইকে আমার কথা বিস্মৃত করে দেয়। সবাই চলে যায় তাদের আপন আপন পথে। নিঃসম্বল আমি পড়ে থাকি আমার নিঃসঙ্গ পৃথিবীতে। কল্পনার চাদর গায়ে জড়িয়ে আমি হেঁটে যাই মেঘেদের দেশে। রাতের নির্ঘুম প্রহরগুলো ঘুরে বেড়াই তারার রাজ্যে । দেখি প্রিয় মানুষদের কোলে মাথা রেখে তোমাদের তৃপ্তির নিদ্রাবিলাস। আমার আপিটার খুব মন খারাপ। স্রষ্টার কাছে সবাই একটু প্রার্থণা করুন। তিনি যেনো আমার আপিটার মন ভালো করে দিন। আপিটা যেনো তাঁর রাজকন্যার স্বপ্নীল আর সুন্দর একটা আগামী গড়ে দিয়ে যেতে পারেন। ভালো হোক পৃথিবীর সব মানুষের। বিশ্বজগতের সকলেই সুখী হোক।