Hafizul Islam

মেয়ে, আমি এখনো তোমার জন্য নিরাপদ বন্ধু আছি কি?

পড়েছেন: 41 জন পাঠক

আইরিন আমার প্রথম মেয়ে বন্ধু। তখন বয়স ৫ এর কোটা পেরোয়নি। চিটাগাংয়ে আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের সরকারি কোয়ার্টারে আমাদের বাসা। পাশের ফ্ল্যাটে থাকতো আইরিনরা। ওরা খুব সম্ভবত ২ বোন। আইরিন বড়। কীভাবে আমরা বন্ধু হয়েছিলাম, কখন কবে ওদের সাথে আমার পরিচয়, এতো বছর পরে এসে ইচ্ছা করলেও আর মনে করতে পারি না।

মেয়ে বন্ধু আলাদা কিছু, তখন সেটা মনে হয়নি। এখনো আমি এভাবেই ভাবি। কিন্তু, এই ভাবনায় ইদানিং সংশয় হচ্ছে। সেদিন ফেসবুকে একজনের ভয়ংকর একটি অভিজ্ঞতার কথা পড়লাম। সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও প্রিয় ছেলে বন্ধুর কাছে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার বর্ননা। পড়তে পড়তে খেয়াল করছিলাম, বিকৃত মানসিকতার ছেলেটিকে ঘৃনা করছি। পাশাপশি ভয়ের একটা শিরশিরে অনুভূতি আমার মেরুদন্ড বেয়ে নেমে যাচ্ছে।

মেয়েটি যে মানসিক আঘাতের মধ্য দিয়ে গিয়েছে ঘটনার রাতে, আমার কোন বন্ধুও কি এমন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে? আমি কি তার দমবন্ধ ক্ষণগুলোতে কোন স্বস্তির কিছু করতে পারছি? দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া আমার প্রিয় বন্ধুটি কি, ছেলে হওয়ার কারণে আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে? এমন সবকিছু মাথায় ঘুরছিলো।

আজকে পরিচিত আরেকজন প্রায় কাছাকাছি অভিজ্ঞতার কথা জানালেন। দু’জনের ক্ষেত্রেই অপরাধী ছিলো ভিকটিমদের প্রিয়জন, সবচেয়ে কাছের বন্ধু! কী ভয়ংকর! যখন এই লেখা লিখছি, মাথায় ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারছি না। এলোমেলো লাগছে। তবুও নিজের জন্য হলেও বলতে চাইছি।

জীবনের প্রায় অর্ধেক পথ হাঁটা শেষ আমার। ক্লাস থ্রি শেষ করার পর ঘর ছেড়েছিলাম। তারপর আর কখনো সত্যিকার অর্থে বাড়িতে ফেরার পথ খুঁজে পাইনি। এই দীর্ঘ যাত্রায় জীবন যেমন আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে বহু মূল্যবান অনেক কিছু। তেমনই আমি পেয়েছি অসাধারণ মানুষদের সান্নিধ্য। পেয়েছি ঝলমলে কিছু বন্ধু, প্রিয়জন। যাদের বয়সের কোন গাছপাথর নেই। কেউ আমার থেকে আগে এসেছে পৃথিবীতে। কেউ আবার আমার অনেক পরে। জেন্ডারগত দিক থেকে ভাগ করলে এদের একটা বড় অংশ মেয়ে।

শুরুতেই বলেছি, আমি ছেলে বন্ধু, মেয়ে বন্ধু আলাদা করে ভাবার মানুষ না। কিন্তু, চারপাশে যেভাবে প্রিয় বন্ধুর কাছে অ্যাবিউজের শিকার হচ্ছে মেয়েরা, তখন আমার মেয়ে বন্ধুদের জন্য ভয় লাগতে শুরু করেছে। বারবার মনে হচ্ছে, ওরাও কি এমন কোন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে কিংবা যাচ্ছে?

নিজেকে ওদের খুব কাছের মানুষ ঘোষনা দিচ্ছি সবসময়। আমার কাছে কি ওরা নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারে? আমি কি আমার প্রিডেটর কিংবা শিকারী মানসিকতাকে সামাল দিতে পারছি? নাকি, বিশেষ কোন দুর্বলতার মুহুর্তে আমারও লুকানো নখ বিশিষ্ট থাবা বেরিয়ে আসবে? সীমারেখা ভুলে গিয়ে লালসার উত্তাপে ঘোলাটে হয়ে উঠবে চোখ?

প্রচলিত বিচারে ব্যক্তি হিসাবে আমি মোটেও কোন চলনসই গোত্রের মধ্যে পড়িনা। সাহস, মানসিক দৃঢ়তা, প্রতিবাদী সত্তার কোনকিছুই অবশিষ্ট নেই হয়তো। মেরুদন্ড হারিয়েছি কবে, সেটাও এখন আর মনে করতে পারিনা। তবুও আমি প্রাণপনে চাই, আর যা হইনা কেনো, আমি যেনো কখনো যৌন নিপীড়ক না হই।

বহুবছর ধরে একটু একটু করে তৈরী করা সংযম, শিক্ষা, প্রিয়জনদের জন্য জমানো ভালোবাসা, আন্তরিক প্রার্থনার গান যেনো আমাকে পথ দেখায়। ঝলমলে হৃদয়ের মন ভালো করে দেয়া প্রিয় বন্ধু, উপচে পড়া মুক্তোর মতো হাসিমুখ নিয়ে অবিরাম কথা বলতে থাকা প্রিয় জুনিয়র, সবসময় ভালো চাওয়া শিক্ষক কিংবা চলতি পথে ক্ষনিকের জন্য আলাপ হওয়া সহজ মানুষদের আন্তরিক সাহচার্য  যেনো আমাকে আটকে দেয়।  স্রষ্টা যেনো আমার চোখ কখনো লোভে ঘোলাটে হতে না দেয়।

সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ কিংবা যেকোন রকমের যৌন নিপীড়ন আমার কাছে মৃত্যুদন্ড পাওয়ার উপযোগী অপরাধ। এর কোন ক্ষমা নেই। কারণ দর্শানোর সুযোগ নেই। এমনকি কোনরকম কৈফিয়তের অবকাশও নেই এখানে। ভিকটিমের  পোশাক, আচরণ, ধর্মীয় রীতি, সামাজিক বিধিনিষেধ না মানা ইত্যাদি কোনকিছু দিয়েই নিপীড়নের পক্ষে কোনরকম যুক্তি দাঁড় করানোর সুযোগ নেই।

সেলফিশ কিংবা আত্ম নিমগ্নতার কারণে চারপাশে ঘটতে থাকা নিপীড়নের ঘটনা আমি এড়িয়ে যাই, যেতে চাই। বাসে কিংবা ভিড়ের মধ্যে যখন কোন নারী নিপীড়নের শিকার হন, আমি শক্ত প্রতিবাদ করি না। ভাবি, ঝামেলায় জড়িয়ে কাজ নেই। এরকম ভাবনা কিংবা অভ্যাসের কারণে নিপীড়করা পার পেয়ে যায়। যাদের শিকার হয় তাদের প্রিয়জনরা। পারভার্ট ব্যক্তি যেমন এসব অন্যায়ের জন্য দায়ী, তেমনই আমিও সমানভাবে অপরাধী। কারণ, আমি প্রতিবাদ না করে নেড়ি কুকুরের মতো লেজ গুটিয়ে নিয়েছি।

আমার মেয়ে বন্ধুরা আমাকে ভালোবাসে। বিশ্বাস করে। আমি তাদের জন্য ভরসার জায়গা। আমার পার্টনার আমাকে সফল মানুষ না হলেও অন্তত নিরাপদ মানুষ মনে করে। আমার চারপাশের নারী প্রিয়জন, মেয়ে বন্ধু, স্নেহের জুনিয়ররা আমাকে নিয়ে ভয়ে থাকে না। কিন্তু, যখন আশেপাশে বন্ধুর কাছে অ্যাবিউজের শিকার হচ্ছে, বিশ্বস্ত প্রিয়জন ভেঙে দিচ্ছে বিশ্বাসের জায়গা, তখন ওরা চাইলেও আমাকে কি নিরাপদ ভাবতে পারছে? নাকি ওদের সংশয় হচ্ছে? কখনো কোন নির্জন সময়ে কি ওরা অনায়াসে আমার পাশে বসতে পারবে? দূরপাল্লার কোন বাসের সিটে আমার কাধে মাথা রেখে ঘুমাতে পারবে নিশ্চিন্ত ঘুম?

আমি জানি না, আসলে কী হবে কিংবা হতে পারে। তবে, আমি প্রাণপনে চাই, আমার বন্ধু-প্রিয়জনরা আমার উপর ভরসা রাখুক। বিশ্বাস না হারাক। আমাকে নিয়ে ওদের সংশয় না হোক। সেই সাথে চাই, ওরা আমার জন্য একইরকম প্রার্থনা করুক। স্রষ্টায় ঈমান রাখা মানুষ আমি। আমি বিশ্বাস করি, স্রষ্টা ওদের প্রার্থনার ভাষা শুনতে পাবেন। আমাকে তিনি রক্ষা করবেন। আমার আদিম হিংস্র নখ, দাঁত, কামনার উষ্ণ নিঃশ্বাস, শুয়োরের মতো লোভী আকাঙক্ষা সংযমের রশিতে আটকে রাখার শক্তি ও সাহস তিনি আমাকে দেবেন।

প্রিয়জনদের জন্য আমি এখনো নিরাপদ বন্ধু আছি। এই কথা আমি বারবার প্রার্থনার বাক্যের মতো জপতে থাকি। পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষ হয়ে জন্মানোর সুযোগ আমাকে, অনেক অন্যায়কে অন্যায় ভাবতে শেখায়নি। ভয়ানক যৌন নিপীড়ন করেও নারীর উপর সহজে দোষ চাপিয়ে নিজেকে পবিত্র ঘোষনার অন্যায় সুবিধা আমার সমাজ আমাকে দেয়। সেজন্যই হয়তো বিশ্বস্ত ছেলে বন্ধুর মুখোশ খসে পড়ে। সে হয়তো ধরেই নেয়, কী আর এমন হবে!

যদি এইটুকু পড়ে থাকেন, আপনি আমার প্রিয়জনদের কেউ হন এবং কোন নারী হন, তাহলে আপনাকেই বলছি। যেকোন ধরণের সেক্সুয়াল অ্যাবিউজের শিকার হয়ে থাকলে আওয়াজ তুলুন। আইনী ব্যবস্থা নিন। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এমন কোন প্রফেশনালের সাহায্য নিন। নিপীড়ক যেই হোক, তার অন্য কোন পরিচয় নিয়ে ভাবার দরকার নেই। আগে তার শাস্তি। তারপর অন্যকিছু। কিছুই করে উঠার সাহস করতে না পারলে, অন্তত নিজেকে দায়ী করা থেকে বিরত থাকুন। মানসিকভাবে ভেঙে পড়টা দোষের কিছু না। কিন্তু, সেটা যেনো আপনার মনোজগতে আঘাতের ছাপ ফেলতে না পারে।

কোন কারণ দর্শানো, খোঁড়া যুক্তি, অহেতুক ব্যাখ্যা ছাড়াই ক্ষমা চাইছি, যারা পুরুষদের কাছ থেকে নারী হওয়ার কারণে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। চারপাশে চলতে থাকা সব ধরণের যৌন নিপীড়ন বন্ধ হবে, এমন কোন কিলসুইচ কিংবা আখেরি সমাধান নেই। এই পরিস্থিতিতে নিজে মানুষ থাকার বিকল্প নেই।

আমি তাই নিপীড়ক না হয়ে ভরসা করার মতো বন্ধু হতে চাই। প্রিয়জনদের জন্য নিরাপদ কেউ হয়ে থাকতে চাই। যেই মানুষগুলো আমার অক্সিজেন, তাদের জন্য আমি অন্তত একটু স্বস্তির দমকা হাওয়া হয়েই থাকতে চাই। প্রাণপন প্রার্থনা করি,  আমি যেনো শিরদাঁড়া শক্ত একজন সহজ মানুষ থাকি। আমার চারপাশের নারীরা চিটাগাংয়ে বন্ধু হওয়া ‘আইরিন’ হোক। প্রিয় সম্পর্কগুলো শৈশবের বন্ধনগুলোর মতো নির্মল থাকুক।

Leave a Comment