Hafizul Islam

বাঁশগাও কিংবা নাখালপাড়া, মৃত্যু সবখানে আমার কাছে একইরকম

পড়েছেন: 177 জন পাঠক

আমাদের ছোটমামা অবশেষে মারাই গেলেন। দীর্ঘদিন রোগ ভোগে চলে যেতে হলো। মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থানা, বাঁশগাও নিবাসী আবদুল হাকিম মোল্লার ছোট ছেলে আবদুল করিম মোল্লা, আমার ছোটমামা। মৃত্যুকালে তার বয়স কত ছিলো, আমি জানি না। জানার ইচ্ছা হয় নি।

নানুবাড়ি আমার কাছে রূপকথার এক রাজ্য ছিলো। বড়মামা, বড়মামী, গল্পবলা বুড়া নানা, ভীষণ আদুরে নানু, বাড়ির সামনে বড় উঠান, ধানের দিনে গরুর মেই দেয়া..। আমার স্মৃতির সবচে দারুন কিছু মুহুর্ত এই বাঁশগাও মোল্লা বাড়িতেই তৈরী।

ছোটমামা ছিলেন আমাদের কাছে সাপোর্টিং ক্যারেক্টার। প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী বড় মামার ছাঁয়া থেকে উনি সম্ভবত কখনোই বেরুতে পারেন নি। বড় মামার মারা গেছেন বহুদিন। উনার মৃত্যুর পর ছোটমামা আমাদের নানুবাড়ির সাথে যোগসূত্র ছিলেন। জায়গা-জমি  নিয়ে অহেতুক ভেজাল আমাদের মাঝখানে ততোদিনে একরকম দেয়াল তুলে দেয়।

ভুল কার ছিলো, দায় কার সে আলাপ এখানে অবান্তর। মামা গ্রাম ছেড়ে এসে উঠলেন নারায়নগঞ্চে নতুন কেনা বাড়িতে। ভাইবোনেরা দাঁড়িয়ে গেলো আদালতে, একে অন্যের বিপক্ষে। বিচ্ছিরি কাঁদা ছোড়াছুড়ির অসহায় দর্শক হলাম আমরা, ছোটরা।

ততোদিনে নানা, নানু, বড়মামা, বড়মামি ছেড়ে গেছেন পৃথিবীর মায়া। আমার শৈশবের রূপকথার রাজ্য পরিণত হয়েছে ঘোস্ট স্টেটে। খুব দরকার না হলে যাওয়ার নামও নিই না। ছোটমামা, মামির সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাও বহুদিন। অসুস্থতায়ও ছিলেন বেশ অনেকদিন। তারপর, সব রেখে হুট করে বিদায়।

যখন ফোন পাই, তখন আমি অফিসে। জুলাইয়ে যমুনা টেলিভিশনে চাকরি শুরু করেছি। কোন একটা আর্টিকেল লিখছিলাম বোধহয়। আম্মা যখন খবরটা জানালো, তখন কেনো যেনো কোন অনুভূতিই টের পাচ্ছিলাম না। ছোটবেলার রাজ্যের এক রাজকুমার মারা গেছে।

আমার মধ্যে কেমন একটা নির্বিকার বিষণ্নতা জন্ম নিচ্ছিলো। হুড়মুড় করে কতো ছোট ছোট মামাময় সময়ের খণ্ডাংশ রিওয়াইন্ড হচ্ছিলো। আহা! আম্মার ছোটভাই, আমার ছোটমামা..।

কোন এক ভর বর্ষায় ছোটমামার কাছে আমার সাতার শেখার হাতেখড়ি হয়। ঠাঁই নেই এমন বিলে নিয়ে গিয়ে হাত ছেড়ে দূরে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, সাতরে আয়। আমার সেদিন মনে হয়েছিলো, মামা আমাকে মেরেই ফেলবে। কিন্তু, হয়েছিলো উল্টো। এই সাতার আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে। সম্ভবত দুইবার।

কিন্তু, অসুস্থতায় মামা যখন চলে যাচ্ছিলেন, উনার জন্য কি কিছু করার ছিলো আমার? হয়তো। আমি উনাকে শেষবার দেখতেও যাই নি। যেতে পারি নি আসলে। উনার সুস্থ যে চেহারা আমার স্মৃতিতে আটকে ছিলো, সেটাই রাখতে চেয়েছি। অসুস্থ উনার ভয়াবহ ভেঙে পড়া মুখ আমার দেখার সাহস হয় নি।

ছোটমামার কবরের পাশেই অনেকদিন আগে মারা যাওয়া উনার মিয়াভাইয়ের কবর। কবরস্থানের পাশেই ঈদগা। উনারা নিয়মিত একসাথে এখানে নামায পড়তেন। নানাও সাথে থাকতো। কখনো আমিও থাকতাম। সুন্দর দিন ছিলো।

আচ্ছা, মৃত্যুর পর নিশ্চয়ই উনাদের আবার দেখা হয়েছে। উনারা কী নিয়ে প্রথম আলাপ শুরু করেছিলেন? পৃথিবীর যাবতীয় বৈষয়িক আলাপের বাইরে গিয়ে উনারা কি একদন্ড আন্তরিক সময় পাড় করতে পেরেছিলেন? জানা যাবে না। ভালো হতো যদি পরলৌকিক কোন ইমেইল সার্ভিস থাকতো।

কিছু মৃত্যু আমাদের কোন কারণ ছাড়াই হয়তো ভাবিত করে। কিছুদিন হলো, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় সিনিয়র ভাই ও পরবর্তীতে বিভাগের শিক্ষক, উনার মা মারা গেছেন। নাখালপাড়া জানাজা হবে জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেখলাম। খবরটা শোনার সাথে সাথে মাথায় প্রথম আসছিলো, খুব প্রিয় কেউ নাই হয়ে গেলো ভাইয়ের জীবন থেকে।

কখনো উনার মায়ের সাথে আমার দেখা হয় নি। তাই, স্মৃতিচারণের সুযোগ নাই। কিন্তু, আমি শিবলী নোমান ভাইকে সামনে রেখে নিজের মতো উনার মাকে খুঁজে নিতে চাইছিলাম। নোমান ভাইয়ের শান্ত হাসিমুখ স্বভাবের অনেকখানি অংশ হয়তো মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছেন। ভারিক্কি জ্ঞানী নোমানের ছোটবেলার মায়ের সাথে কাটানো সময়গুলো কেমন ছিলো..।

মা কি তখন থেকে জানতেন, তার ছেলে কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের আসনে বসবে..। হয়তো জানতেন। মায়েরা অনেককিছু আন্দাজ করতে পারেন আগে থেকে, আমার এমন ভাবতে ভালো লাগে।

নোমান ভাইয়ের জীবনে হুট করে ইতি পড়লো একটি সুদীর্ঘ অধ্যায়ের। সামনের দিনগুলো আর আগের মতো হবে না। ঈদ, পার্বনগুলোতে ভিন্ন ধরন তৈরী হবে। মা ডাকার সিলেবল ভুলে যেতে থাকবে ব্রেইন। হয়তো নতুন কোন সময়ে নিজের মেয়ের মধ্যে কখনো খুঁজবেন মাকে। হয়তো..। কিন্তু, মায়ের সময়টা ফাইলবন্দি করে ফেলতেই হলো নোমান মাস্টারকে।

আহা সময়! কতো ভালোবাসা, স্মৃতি, দুঃখ, সহমর্মিতা, আন্তরিক প্রার্থনা জড়িয়ে ছিলো মা-ছেলেকে। সবকিছু থেমে গেছে। যায়। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, আমাদের জন্য যেটা স্বাভাবিক লাগছে, শিবলী নোমানের কাছে সেটা মোটেও কি স্বাভাবিক? হয়তো..। হয়তো না।

এইযে নাই হয়ে যাওয়া, ছিলো-নেই লুকোচুরি, এইখানে নাখালপাড়া আর বাঁশগাওয়ের কোন তফাৎ নেই। আমার ছোটমামা আর শিবলী নোমানের মা, তাদের অন্তর্ধান সবকিছু মিলেমিশে এক হয়ে যায়। আমাদের আগামীকালগুলো আগের মতো থাকে না। আমরাও বদলে যাই।

প্রিয়জনদের প্রতিটি মৃত্যু আমাদের পাল্টে দেয়। এক একটা সময় আমরা হয়তো শোকগ্রস্থ হতেও ভুলে যাই। যে জীবন আমাদের সামনে হেসে খেলে কাটছিলো, সেই জীবনের এমন ধুম করে নাই হয়ে যাওয়া আমরা সহজে নিতে হয়তো কখনো শিখবো..হয়তো।

Leave a Comment