Hafizul Islam

‘হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল’ ছিলেন কি আমাদের হৃদয় ভাই?

পড়েছেন: 73 জন পাঠক

‘হৃদয় ভাই আর নাই! শুনছেন নাকি খবর?’ সহকর্মী মুনীমের ফোন পেয়ে চমকে উঠেছি। বলে কি! হৃদয় ভাই আত্মহত্যা করেছে! এইটা অসম্ভব। মনে মনে বলছিলাম, ‘আরে এমন কিছু হয়নি। একটু পর জানা যাবে, আসল খবর’।

ঘুম থেকে উঠে বসে আছি। সোশ্যাল মিডিয়া চেক করছিলাম। আগের দিন ডে অফ ছিলো। বিছানায় বসে বসেই ভাবছিলাম, ছুটি শেষ, বিকালের শিফটে অফিস। এমন সময় সহকর্মীর এমন মৃত্যুর খবর আমাকে একরকম স্তম্ভিত করে দিয়েছে। মাথা হঠাৎ করেই যেনো ব্ল্যাংক, খালি হয়ে গেছে। ছোটবেলায় পরীক্ষার সময় খাতা হাতে পাওয়ার পর এমন হতো। কিছুই মনে পড়তে চাইতো না। টেবিলে পড়ে থাকতো সাদা খাতা, আহত বিকালের মতো।

হৃদয় ভাইয়ের সাথে প্রথম কীভাবে আলাপ শুরু হয়েছিলো, স্মরণ করতে পারলাম না। উনি আসতেন দামী একটা বাইকে চড়ে। দেখতে শুনতে সুদর্শন মানুষ। হাসিখুশি। খোলামেলা আলাপী। ফিটফাট আসতেন অফিসে। দেখা হলেই হাসিমুখে কথা বলতেন। বাইক কিনেছেন এইতো কয়েকমাস আগে। শখের বাইক। মজা করলে বলতাম, ‘ভাই, আপনার বাসাটা যদি মিরপুর হইতো, কতো যে ভালো হইতো’। উনি বলতেন, ‘চলেন, ১০ নাম্বারে নামায় দিয়ে যাবো নে আপনাকে’।

গত ৭ অথবা ৬ তারিখে সন্ধ্যা। অফিসের ক্যান্টিনে বসে গরম গরম পুরি খেলাম। ওয়ানটাইম কাপে চা নিয়ে বসে আছি। মোবাইল চেক করছি। হৃদয় ভাই এসে বললেন, ‘আরে ভাই, কী খবর? খাইছেন? পুরি আনবো?’ আমি জানালাম, খেয়েই বসে আছি। একটু পর আমাদের ডেস্কের ইনচার্জ রুবেল ভাই আসলেন , সাথে উনার স্ত্রী। বসলেন আমাদের টেবিলে। হৃদয় ভাই হাতে করে ভাই-ভাবীর জন্য পুরি আর সিঙারা আনলেন। খেতে খেতে হৃদয় ভাই বলছিলেন, চাটনী দিয়ে পুরি-সিঙারা খেতে। উনার খুব ভালো লাগে ক্যান্টিনের চাটনী।

সদ্য ভেজে আনা পুরি থেকে ধোঁয়া উড়ছে। সিঙারার গায়ে লেগে আছে মৃদু উম। পুদিনা-মরিচের চাটনীর সবুজ রঙ ক্যান্টিনের মরা আলোয় দেখতে গাঢ় কালচে লাগছিলো। আমরা গল্প করছিলাম, ট্রেন জার্নি নিয়ে। দ্রুতগামী গাড়িতে করে গন্তব্য যাওয়ার অভিজ্ঞতা। রুবেল ভাই, ভাবী বলছিলেন, ভয়ংকর অ্যাক্সিডেন্টের স্মৃতি। নাস্তা শেষে আমরা আবার ডেস্কে ফিরলাম। কাজে ডুবে যাওয়া আমি কি তখনো জানতাম, সেটাই আমাদের শেষ দেখা?

আজকে অফিসে আসার পর থেকে মাথা শুন্য হয়েই আছে। এখনো। কিচ্ছু ভাবছি না। শুনছি না। দেখছি ঠিকই, কিন্তু চলমান দৃশ্যগুলো অপরিচিত কোন ভাষার ছড়ানো আলফাবেট মনে হচ্ছে। কেনো হৃদয় ভাই আত্মহত্যা করলেন, কখন কী হলো, কীভাবে হলো, এসব নিয়ে অফিসে অনেক রকম কথা হচ্ছে। দিনের পর দিন একসাথে কাজ করা সহকর্মীর এমন আকস্মিক বিদায় আমাদের কারো জন্যই সহজ না। কেউ চুপচাপ বসে কাজে মাথা গুজে আছে। কেউ একটু পরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। কেউ এই টেবিল থেকে ওই টেবিল ইতস্তত যাচ্ছে আসছে। জোম্বির মতো কেবল কাটিয়ে দিচ্ছে সময়।

আমি কিছু জানতে চাইছি না। চাই না। কেনো কীভাবে কখন হৃদয় ভাই বিদায় নিয়েছেন, আমার জানার আগ্রহ হচ্ছে না। আমার মাথায় ঘুরে ফিরে আসছে, হৃদয় ভাই নেই। উনার সাথে আর কখনোই আমার দেখা হবে না। বাইকের হেলমেট হাতে হাসিমুখ হৃদয় ভাই আর কখনো বলবেন না, ‘ভাই, আপনার আইটেমের টাইটেলটা জমলো না। থাম্বনেইলটা সুন্দর হইছে। এইখানে ফটোশপের কী কাজটা করেছেন, বলেন তো। আপনেতো মিয়া ম্যালা কাজটাজ জানেন। আমাদের একটু শিখান’।

টুকরো টুকরো অজস্র স্মৃতি, আলাপের খন্ডাংশ, হাসিমুখ, বিরক্তি, সহমর্মী মুহুর্ত- সবকিছু নেচে বেড়াচ্ছে মাথার মধ্যে। কতো কষ্টই না জমা হয়ে গিয়েছিলো হৃদয়ের অন্তরে। আমরা এতো কাছে বসেও কখনো ছুঁতে পারিনি উনার একটুকু দুঃখ। কখনো জানতেও চাইনি, আসলেই কী ভালো ছিলেন হৃদয় ভাই..।

‘হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল’ হয়তো ছিলেন। ‘শুধাইনি’ কখনো। কতো ব্যস্ততা আমাদের! অথচ, আজকে আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ার টাইমলাইন ভেসে যাচ্ছে শোকের পোস্টে। আমি আগবাড়িয়ে আদিখ্যেতা করে ব্লগ লিখছি। আমাদের টিভি স্টেশনে সংবাদ দেখানো হয়েছে। এসবের কোনকিছুই আর হৃদয় ভাইকে স্পর্শ করবে না। তিনি জানতেও পারবেন না, আমাদের সম্মিলিত বেদনার আকারটা হয়তো উনার ব্যক্তিগত দুঃখের ভার একটু হলেও কমাতে পারতো।

অসংখ্য মৃত্যু দেখা আমি, প্রিয়জনদের দাফন-কাফনে অংশ নেয়া আমি, সহজে কারো মারা যাওয়ার ঘটনা মেনে নিতে পারা আমি- এখন আর কোন মৃত্যুকেই প্রশ্ন করি না। আত্মহত্যা আমার কাছে পৃথিবীর অন্যতম উচ্চকিত চিৎকার। Loudest scream of a Bleeding Heart which can’t reach our hearing. সবকিছু নিয়ে, সবকিছু পেছনে ফেলে রেখে, সবার ধরাছোঁয়ার উর্ধ্বে চলে যাওয়ার এতো তাড়া কেনো হয়েছিলো, হৃদয় ভাই?

Leave a Comment