Hafizul Islam

তিন খন্ড বস্ত্র কিংবা একটি থ্রি কালার স্যুট!

পড়েছেন: 636 জন পাঠক

তিন খন্ডের পোশাক
মূল : আলী দেভ, তিউনেশিয়া
ভাষান্তর : রাহিমা দেওয়ান

= = ===================

এই মাস থেকে প্রথমবারের মতো পরিবারের অগ্রিম আয়-ব্যায় বিবরনীতে স্থান পেয়েছে আমিষজাত খাদ্যপণ্য-গোমাংশ। আমার জন্য রাখা হয়েছে ক্ষুদ্র অনুপূরক। যা ছিলো কল্পনাতীত।

আমি জানি না, কেনো আমি আমার চিরায়ত আচরণবিধির বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করলাম। আর কেনোইবা অতর্কিতে তিন খন্ডের একটি সুমার্জিত ছাঁটের পোশাক কিনে ফেললাম। পছন্দ-আবশ্যক আকাশনীল, জঁমকালো ইংলিশ কাপড়ে রচিত হয়েছে তার বুননকার্য। রংটি যেনো কোনো সূর্যদীপ্ত আলো-ঝলমলে উজ্জ্বল দিবসের। সুনিপূণ দক্ষতায় যে বয়নশিল্পী সুচারুরূপে তৈরী করেছে পোশাকটি, সে যেনো তার সৃষ্টির মাধ্যমে বলতে চেয়েছিলো, হে পোশাকের প্রভূ! একত্রে জন্মেছিলাম আমরা-একে অন্যের জন্য। রৌদ্ররশ্মিতে তার (পোশাকের) বোতামগুলো সাহসী নাবিকের বাহুতে ঝোলানো সম্মানিত পদক-তারকার মতো জ্বলজ্বল করছিলো।

আমার অস্থির উত্তেজনার পরিমাণ ছিলো ভয়াবহ। ফলে আমি ক্রয়মূল্যের শেষ অংক পর্যন্ত পৌছতে পারছিলাম না। ওড়তে থাকা রঙিন পালকের মতো লাগছিলো সবকিছু। মাথা আর বাহু দুলিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম, বলতে পারো কেমন হয়েছে আমার পোশাক? আবার আমিই বলছিলাম, কে তুমি?

কোন ধরনের দ্বিধা ছাড়াই বড়ো রাস্তার সর্ববৃহৎ ক্যাফে অভিমুখে আমার যাত্রাপথ তৈরী করে নিয়েছিলাম। অতঃপর, আমি তাতেই রয়েছি। বন্ধুরা আমায় নিয়ে অযথাই হইচই করতে শুরু করেছে। আমায় সুড়সুড়ি দিচ্ছে, আঘাত করছে তাদের আঙুলের মৃদু তাড়নে। আমি খুব বিরক্ত এবং অসহায় বোধ করছি। গর্ব জাগছে নিজের ভেতর! একটি বন্দি টিয়ে পাখির মতো!! কিছুপরে আমি একতাড়া ন্যাপকিন আর সিগারেট নিয়ে এলাম। প্রত্যেকে ঠিকঠাক তাঁদের ভাগ বুঝে নিলো। একজন বলে উঠলো, আমি আসলে ধূমপান করি না। কিন্তু বড় সুন্দর সময় কাটছে। কি আনন্দ! আমি তখন বললাম, ধূমপানকারীরা দূষণ আর নিকোটিনের জন্মদাতা হয়ে থাকে। স্বাভাবিক ভাবেই আমাকে দারুণ সঙ্গ দেয়া ওয়েটারের টিপ্স্ থেকে শুরু করে বিলের সম্পূর্ণটাই পরিশোধ করতে হলো।

সেখানে তখন দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত উর্ধগতি এবং অনাগত জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত চড়াদামে কিনে নিয়ে বেঁচে থাকার কায়িক শ্রম নিয়ে কথা হচ্ছিলো।

তাদের একজন আমার কানের পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, এটা কোন ধরনের পোশাক? তারপর সে আমাকে নিয়ে এলো একটি দোকানে। শিল্পপতি নামক অর্থের জীবন্ত বাক্সগুলো যেখানে ঐশ্বর্যিক উপকরণের খোঁজে ঘুরে বেড়ায়। তার সুশ্রাব্য শব্দরাশির তোড়ে আমার পকেট ধীরে ধীরে তার অনুগত ভক্তে পরিণত হচ্ছিলো। একটু পর সেখানে এখন নিরেট শূণ্যতা। কঠিন হলেও আমি একটা ফিরতি টিকেট জুটিয়ে ফেললাম। পরবর্তী পুরো এক সপ্তাহ আমি আমার জমার হিসেবহিটা পূর্ণ করতে প্রাণপন খেটে গেলাম। বাটার-ডিম ইত্যাদি বিলাসী খাবার খেতে নিজেকে একরকম বাধ্য করছিলাম। আমি আমার গোশত এবং সিগারেটের বরাদ্দ অর্ধেকটা বন্ধুদের জন্য উৎসর্গেও মনস্থ করছিলাম।

আমি দামী সেভিং ক্রিম আর তারপরের সুগন্ধী স্প্রে দিয়ে ঢেকে দিতে চাইছিলাম আমার অতীত মুখায়বব। যেখানে দিনরাত খেটে মরা স্বল্প বেতনের একজন কেরানীর জমাট ক্লান্তির আঁকিবুকি রেখা। আমি এখন কিছুটা উদ্ধত। মেয়েদের গায়ের গন্ধ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলছি। হঠাৎ স্মৃতি আমার হৃদয়ে অবকাশ যাপনের ভ্রমণে থাকা এক তরুণীর আবছাঁয়া মুখে তীব্র আলোর ঝলক ফেললো। আমার তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তি কী আমায় ছেড়ে যাচ্ছে? অথচ আমি আমার জুতার বয়স হিসেব করে ফেলতে পারি! হায় ঈশ্বর! দিনগুলো কিভাবে গলে গলে ঝরছে অবিরল ? আমার বন্ধুরা আমায় কিছুটা এড়িয়ে চলছে কি? তাদের মতে, সুবিশাল আনন্দপ্রবাহ, প্রতিবন্ধকতা তৈরী করছে ছোট্ট এককাপ কফির স্থির শান্তির মাঝে। আমি চলছি। একটি রাস্তায় দাঁড়িয়ে শুনছি প্রচন্ড ক্রোধে ঝড় জেগে উঠার শব্দ। প্রকৃতি একটি অশুভ সংকেত দিতে চাইছে বোধহয়। দূর দিগন্তের ভীষণ আকারের কালো মেঘগুলো বৈকালিক ভ্রমনে বেরিয়েছে যেনো। বার্সেলোনা স্কয়ারে আমি কিছু ভিক্ষুককে সারবেঁধে ভিক্ষা করতে দেখলাম। তাদের বাঁকাচোড়া মুখ, অর্ধঝুলের অকেজো হাত, বিশ্রি আওয়াজ আমার ভেতরে কেমন একটা ভীতিকর শিহরণ জাগিয়ে তুলছিলো। আমি তাদের প্রত্যেককে শতখানেক করে টাকা দিয়ে রিলিফ কার্ডে স্বাক্ষর করলাম। তাদের দলনেতা আমায় বললো, তোমার আরো কিছু দেয়া উচিৎ। আমি খুচরো কয়েনগুলো ছড়িয়ে দিলাম ওদের চারপাশে। দ্বিগুণ মূল্যে আমি কিনে নিলাম ওদের দুর্লভ নীরবতা।

আমি হাঁটছিলাম বেশ তাড়াহুড়া করে। পালিশ করা জুতা আর আয়রণ করা বহুমূল্যের পোশাক বাঁচিয়ে। ভিজে চুপসে যাওয়া জামা আর জুতার বেহাল অবস্থা।

বেশ ভালে একটা ঘুম হয়ে গেলো। হঠাৎ মনে পড়লো, বসন্ত প্রায় সমাগত। আমার একটা কোট এবং একজোড়া জুতার খুব প্রয়োজন। আমি কি এই মাসে বাড়িটা বাঁচাতে পারবো? এতো এতো ঋণ শোধ হবে কী করে? রেশনের টাকাটা জোগাড় না হলে…মেয়েটার ওষুধ…আমি আর ভাবতে চাইলাম না। ট্রেন চলছে সগর্জনে। নিত্যকার সেই একই ঘেরাটোপ। আমি ঘুরছি শিশু পার্কের ট্রয়ট্রেনের মতো। আমি বসে আছি থার্ড ক্লাসে। কর্তৃপক্ষের দয়ার উপর নির্ভর করে। হলদে দাঁতের ক্ষয়াটে চেহারার টিকেট মাষ্টারের ঠোটে ঝোলানো হাসিটা আমার কাছে, প্রায়ই রেশনের দোকেনের মিনি সাইনবোর্ড বলে মনে হয়। বার্সেলোনা স্কয়ারে এসে অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলো কিনে নিলাম। সেলসগার্লটি একটি ব্যাগ দেয়ার কোনো প্রয়োজনই বোধ করলো না। আমি তাদেও চাহিদামাফিক সামগ্রী ক্রয় করতে পারিনি বলেই হয়তো। পণ্যগুলো বাহুতে ঝুলিয়ে হাঁটছিলাম আমি। আমার মাথাটা আনমনে দুলছে। জিহ্ববা অসাড় পরে আছে দু’চোয়ালের মাঝে। ওকে (জিহ্ববাকে) ব্যস্ত করার রসদ যোগাড় করতে পারিনি। আমি শান্ত হবার ব্যর্থ চেষ্টায় এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালাম কিছুক্ষণ। এমন করেই দিন কাটছে। আমি অবিশ্বাস্য ধৈর্যে অতিক্রম করে যাচ্ছি শতাব্দীর অতল বাঁকগুলো। অথচ হয়ে আছি ভীষণ বোকা। আমি আবার আমার প্রকৃতবাস্তব পৃথিবীতে পথ চলি। আজ থেকে কোনো কিছুই হয়তো আমার কিচ্ছু করতে পারবে না।

তবে আমার একটা থ্রি-কালারের স্যুট খুবই প্রয়োজন। না হলে আমার ছেলেটার আর স্কুলে যাওয়া হবে না!

Leave a Comment