মনে করুন, আপনি চেক রিপাবলিকে বেড়াতে গিয়ে উঠলেন এক দারুন প্রাসাদে। শহর থেকে একটু দূরের পাহাড়ে জমকালো প্রাচীন প্রাসাদ। বিকেলের সোনালী আলোয় চমৎকার চারপাশ দেখতে বেশ লাগছিলো। রাতে কেয়ারটেকার ডিনারের আয়োজন শেষে চলে গেলো আপনাকে রেখে। গা ছমছম বিশাল প্রাসাদের কিংসাইজ বেডে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছেন আপনি। দারুন রোমাঞ্চকর পরিবেশ।
এমন সময় শুনলেন, হলঘরে কেউ হালকা পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কৌতুহলী হয়ে গিয়ে দেখলেন কেউ নেই কোথাও। ফিরে আসবেন তখন শুনেতে পেলেন তীক্ষ্ণ এবং রোমহর্ষক চিৎকারের শব্দ ভেসে আসছে প্রার্থনাঘরের মার্বেল মেঝের নীচ থেকে। এমন ভয়ংকর শব্দ আপনি কখনো আর শোনেন নি! আপনার শিঁড়দাড়া বেয়ে শীতল ঘামের স্রোত গড়িয়ে নামছে। রাজকীয় প্রাসাদে রাত্রিযাপন কিংবা চেক রিপাবলিকে ভ্রমণ তখন কেমন লাগবে?
এমনই এক জায়গার গল্প বলছি আজকে। একটি ভয়ংকর প্রাসাদের কাহিনী। প্রাসাদের নাম হৌসকা ক্যাসল। হৌসকা শব্দটি চেক রিপাবলিকের ট্রাডিশনাল এক প্রকার রুটির নাম। রুটিটি দেখতে উল্টানো গামলার মতো লাগে। হৌসকা ক্যাসল চেক রিপাবলিকের পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত একটি রহস্যজনক প্রাসাদ। গহীন অরণ্য, বন্ধুর পাথুড়ে এলাকা আর দমবন্ধ করা জলাভূমির প্রান্তে দাঁড়ানো এই প্রাসাদ যেমন অভিযাত্রীর জন্য দুর্গম। তেমনই একে ঘিরে আছে অশুভ আত্মা আর ভয়ংকর কিংবদন্তির নানা রূপকথার গল্প। এইসব গল্পের কোন কোন অংশ সত্যি বলে ধরে নিয়েছে স্থানীয়রা। ১৩শ শতকের কোন এক সময় রাজা ওটোকার ২ এর সময়কালে নির্মিত হয় এই প্রাসাদ। বোহেমিয়া অঞ্চলে তখন গথিক আর্কিটেকচার বা গথিক নির্মাণশৈলীর প্রভাব ছিলো। সেই অনুসারেই ১২৫৩ সাল থেকে ১২৭৮ সালের মাঝে গোড়াপত্তন ঘটে হৌসকা ক্যাসলের। দক্ষিণ প্রাগ থেকে ঘন্টাখানেকের দূরত্বে বর্তমানে এর অবস্থান। স্থানটি পৃথিবীর অন্যতম রহস্যজনক ও ভয়ংকর স্থাপনা বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।
প্রথম দেখায় প্রাসাদটিকে খুব সাধারণ মনে হলেও গভীরভাবে লক্ষ্য করলে কিছু অদ্ভূত বৈশিষ্ট্য চোখে পড়বে। প্রথমত , প্রাসাদের অনেক জানালাই ফেইক কিংবা বলা যায় শুধুমাত্র জানালার আকার দেয়ার জন্যই এভাবে তৈরী হয়েছিলো। যদি ভালো করে নজর দেয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে বেশিরভাগ জানালা বাড়ির সামনের দিকে মুখ করে আছে। শুধু পাতলা কাঁচ দেয়া। কাঁচের পেছনে কঠিনভাবে নির্মাণ করা রুক্ষ দেয়াল। এই দেয়ালের সামনে কাঁচ দিয়ে কেনো জানালা বানানো হয়েছে, বুঝতে পারা যায় নি। দ্বিতীয়ত, প্রাসাদের নিরাপত্তার জন্য কোন প্রাচীর ছিলো না। যেটা সেইসময় বহিরাগত আক্রমণ ঠেকাতে বেশিরভাগ প্রাসাদেই প্রায় বাধ্যতামূলক অনুষঙ্গ ছিলো। এবং, এই প্রাসাদে কোন পানির সোর্স ছিলো না। ছিলো না কোন রান্নাঘর। নির্মাণের বহুবছর পরেও তাতে কোন বসবাসকারী কিংবা অধিবাসী কাউকে দেখা যায় নি। এই বিষয়গুলো থেকে বুঝতে পারা যায় যে হৌসকা ক্যাসল কোন বন্দিখানা কিংবা কোন আবাসিক স্থাপনা হিসেবে নির্মিত হয় নি।
প্রাসাদের অবস্থানটা বেশ অবাক করা জায়গায়। শহর থেকে দূরে দুর্গম পাহাড়ি এলাকা, ঘন জঙ্গল আর জলাভূমি দিয়ে ঘিরে থাকা স্থানে হৌসকা ক্যাসল দাঁড়িয়ে আছে। এই জায়গার বিশেষ স্ট্র্যাটেজিক বা কৌশলগত কোন গুরুত্ব নেই। এমনকি এর অবস্থান কোন ব্যবসার রুটেও অবিস্থত না। বেশিরভাগ মানুষের কাছেই এটা বিস্ময়কর যে, হৌসকা ক্যাসল কেনো এমন একটা জায়গায়! হয়তো সুপ্রাচীন কিংবদন্তি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে।
ফোকলোর বা লোককাহিনী অনুসারে, হৌসকা ক্যাসল গভীর একটি গর্ত, সুড়ঙ্গের উপর নির্মিত। যাকে নরকের দরজা নামে ডাকা হতো। বলা হয় সেই গর্তটা এতো বেশি গভীর যে , কেউ কখনো এর তলদেশ দেখে নি। রাত যখন বেড়ে উঠে, তখন সেই গর্তের ভেতর দিয়ে পাতাল থেকে অর্ধেক মানুষ অর্ধেক প্রাণীর মতো অদ্ভূত কিছু জন্তু উঠে আসে এই পৃথিবীতে। কালো পাখার এইনব জন্তুরা স্থানীয়দের উপর আক্রমণ চালাতো এবং তাদের ধরে নিয়ে যেতো নেই গর্তে। নরকের দিকে। বিশ্বাস করা হতো এই প্রাসাদ নির্মাণ করে হয়েছে শয়তানকে বন্দি করে রাখার জন্য।
এই জায়গাটা বিশেষ করে নির্বাচন করা হয়েছিলো একটি কারণে। যাতে নরকের দরজা দিয়ে অশুভ আত্মার আগমনের পথ ঢেকে দেয়া যায়। প্রাসাদের ভেতরে যে চ্যাপেল বা প্রার্থণা ঘর, সেটা নির্মাণ করা হয়েছে তলহীন গর্তের একেবারে উপরে ঢাকনার মতো করে নির্মাণ করা হয়েছে। শয়তানের পথ আটকে দেয়ার জন্য সেই পথটাকে সিলগালা করে দেয়া হয়েছিলো। উদ্দেশ্য ছিলো যাতে নরকের জন্তুরা আমাদের পৃথিবীতে আর না আসতে পারে। কিন্তু, প্রায় ৭০০ বছর পরে এসেও দর্শনার্থীরা সেই সিলগালা চ্যাপেলের ভেতর থেকে রাতের বেলা ভয়ংকর শব্দ শুনতে পারতো।
যখন এই প্রাসাদের নির্মাণকাজ শুরু হয়, তখন ঘোষণা আসে যে, গ্রামে যেসব কায়েদীরা দীর্ঘজীবনের জন্য সাজা ভোগ করছে, তাদের মুক্তি পাওয়ার সুযোগ এসেছে। সভ্যতা থেকে দূরে এবং ভীষণ দুর্গম হওয়াতে যাবৎজীবন কারাদন্ড পাওয়া আসামীদের এইগ্রামে নির্বাসন দেয়া হতো। তারা ঘোষণা শুনে বেশ আনন্দিত হয়। তাদের বলা হয়, যারা এই তলদেশহীন গুহায় নেমে সবকিছু দেখে এসে জানাতে পারবে, তারা মুক্তি পাবে বন্দিদশা থেকে। তখন অনেকেই আগ্রহী হয়ে এগিয়ে আসে। প্রথমে একজনকে রশির পুলিতে করে বেঁধে দিয়ে নামানো হতে থাকে গুহায়। অতল অন্ধকারে অদৃশ্য হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই লোকটির হিমশীতল চিৎকারের শব্দ শুনতে পায় সকলে। লোকটি প্রাণপণে করুণা ভিক্ষার মতো করে বলছিলো, তাকে যেনো উপরে উঠিয়ে নেয়া হয় এক্ষুণি। যখন যুবক বন্দি লোকটিকে উপরে তোলা হলো, তখন দেখা গেলো তার বয়স গুহায় থাকার কয়েক মুহুর্তে প্রায় ৩০ বছরের মতো বেড়ে গেছে।
তার সব চুল সাদা হয়ে গেছে। চেহারায় বয়সের ছাঁপ এঁকে গেছে স্পষ্টভাবে। চামড়ার ভাঁজ, চোখের কোণ, দৃষ্টি সবকিছুতেই বৃদ্ধ ও ক্লান্ত মানুষের ছাঁয়া। উপরে উঠিয়ে আনার পরও লোকটি চিৎকার করছিলো ভয়ংকর আওয়াজে। তার এই অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিলো, অন্ধকারের অতল গুহায় এমন কিছুর সাথে তার দেখা হয়েছে, যা সহ্যের ক্ষমতা আমাদের পৃথিবীর মানুষের নেই। অপ্রকিতস্থ লোকটিকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হলেও অজানা কারণে পরের দুইদিনের ভেতর তার মৃত্যু ঘটে। তারপর থেকে কেউ আর সেই সাহস করে নি।
বহুবছর পেরিয়ে গেছে সেদিনের পর। কিংবদন্তি বলে, আটকা পড়া দেয়ালের কারাগারের মধ্যে অন্ধকারের প্রাণীদের পাখা আঁচড়ানোর শব্দ এখনো পাওয়া যায়। প্রাসাদের সুবিস্তৃত হলরুমে এখনো হাঁটতে দেখা যায় অশুভ আত্মাদের। যারা মুক্তি কিংবা পৃথিবী দখলের অভিপ্রায়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে এই সবুজ গ্রহে। কখনো নাকি দেখা যায় মস্তকবিহীন বিশালাকার একটি ঘোড়াকে, সামনের ছোট্ট আঙিনায় ঘুড়ে বেড়াতে।
খুব সাম্প্রতিক ইতিহাস বলতে গেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে এই ক্যাসল ব্যবহারের কথা খুঁজে পাওয়া যায়। জার্মান শক্তি যখন পৃথিবীর উপর প্রভাব বিস্তার করছে, বিশ্বযুদ্ধের ঘনঘটা গোটা ইউরোপ জুড়ে, তখন নাজিশক্তি বা জার্মান কেন্দ্রীয় কমান্ডের কেউ কেউ বিশ্বাস রাখতেন অশুভ আত্মার অসীম ক্ষমতার উপর। তারা এই হৌসকা ক্যাসল দখল করে ছিলো অশুভ শক্তিতে কব্জা করে নিজেদের কাজে ব্যবহারের আশায়। কিন্তু, তাতে সফলতা আসার কোন প্রমাণ কখনো পাওয়া যায় নি। পরবর্তীকালে সংস্কারের সময় প্রাসাদে অনেক নাজি অফিসারের কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিলো। যাদের মৃত্যুদন্ডের কোন পদ্ধতিতে মারা হয়েছে বলে প্রমাণ মেলে।
অনেকেই মনে করেন, নাজিদের একটি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ছিলো হৌসকা। মানুষের ভীতিকে পুঁজি করে তারা গোপনে কোন আবিষ্কারের চেষ্টা করছিলো এইখানে। আবার, অনেকে মনে করেন, অতৃপ্ত আত্মারা এখনো এই পথে নরকের অন্ধকার জগতে প্রবেশ করে। বাস্তববাদী অনেকে আবার বলেন, সবকিছু ভিত্তিহীন গল্প। কোন সম্পদশালী পাগলাটে জমিদারের খেয়ালি নির্মাণ এই হৌসকা ক্যাসল।
সত্য যাই হোক, সেটা নিয়ে মানুষের গবেষণা চলবে। অনেক বিখ্যাত টিভি শো এর নির্মাতারা দেখিয়েছেন এই প্রাসাদ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য কাহিনী, রূপকথা, রচনা, ডিজিটাল কনটেন্ট। সবকিছুর পরেও হৌসকা এখনো পৃথিবীর অন্যতম ভয়ংকর আকর্ষণের জায়গা হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে। জানি না এই প্রাসাদের প্রকৃত কাহিনী কী ছিলো। যিনি তৈরী করেছিলেন এই প্রাসাদ, তার ভাবনা কী ছিলো, তাও জানা যায় নি। তবে, ভয়ংকর ও অমীমাংসিত হলেও এই প্রাসাদ শেষ অবধি মানুষের সদম্ভে টিকে থাকার কথাই ঘোষণা করে।
আপনি যদি কখনো চেক রিপাবলিকে যান, তাহলে প্রাগের খুব কাছের এই বিখ্যাত কিংবা কুখ্যাত বাড়িটি থেকে ঘুরে আসবেন। কে জানে, অন্ধকারের কোন আত্মার সাথে হয়তো আপনার দেখা হয়ে যেতে পারে।
তথ্য ও ছবি কৃতজ্ঞতাঃ
১। ট্রেসবোহেমেস
২। কুলস্টাফ
৩। উইয়ার্ড ওয়ার্ল্ড
লেখাটি পার্থিব নামে একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছিলো। সাইটটি বন্ধ হওয়াতে লেখাটি ব্যক্তিগত ব্লগে পোস্ট করা হয়েছে। ফিচার ইমেজটি পুরনো লেখার সাথে পাবলিশ হয়েছিলো।