Hafizul Islam

কিংবদন্তিতে মহাপরাক্রমশালী সূর্য ; সৌর দেবতা থেকে উড়ন্ত রথের গল্প

পড়েছেন: 1,355 জন পাঠক

শত সহস্র বছর আগে থেকেই মানুষ সূর্যকে জীবনের উৎস হিসেবে মেনে নিয়েছিলো। বিজ্ঞান যতোদিনে আবিষ্কার করে যে, সূর্যের চারপাশে সবকিছু প্রদক্ষিণ করে, তারও বহুকাল পূর্বেই আদিম মানুষেরা সূর্যকে শক্তির আধার হিসেবে গ্রহণ করেছিলো। প্রাচীন ইতিহাসে সূর্য যেমন শক্তি ও প্রাণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো, তেমনই সূর্যকে মনে করা হতো স্রষ্টা কিংবা দেবতা।

কোন কোন প্রাচীন সভ্যতায় সূর্য ছিলো জীবনের প্রতীক। কখনো এই প্রতীকের প্রকাশ হতো দেবতার রূপে। আবার কখনো তাকে দেখা হতো দুই ঘোড়ায় টানা রথের ্আকৃতিতে। সূর্য নিয়ে এমন কিছু কিংবদন্তির গল্প তুলে ধরা হলো পাঠকের জন্য।

১। অ্যাজটেক সভ্যতা (মেক্সিকো)

পঞ্চম সূর্যদেবতার আত্ম উৎসর্গ

অ্যাজটেকরা মনে করতো, তারা সূর্যের পঞ্চম সংস্করণের সময়কালে আছে। আগের চারটি সূর্য ক্রমান্বয়ে জাগুয়ার, হ্যারিকেন, আগুনে বৃষ্টি ও ভয়ংকর বন্যায় ধ্বংস হয়ে গেছে। গড বা ঈশ্বর নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছেন এই পঞ্চম সূর্য হওয়ার জন্য। যাকে ন্যান-হুয়াট-জিন বা মোড়কে ঢাকা ঈশ্বর বলে ডাকা হতো। তিনি নিজের আত্মহুতি দিয়েছিলেন এক স্বর্গীয় অগ্নিতে, যা বাতাসের দেবতা এ্যাহেকাটল-কোয়েটজালকোট কর্তৃক প্রজ্জলিত হয়েছিলো।

২। প্রাচীন চায়নিজ/চৈনিক সভ্যতা (চীন)

সূর্য ও তীরন্দাজ
প্রাচীন চীনে বিশ্বাস করা হতো, ১০ টি সূর্য রয়েছে সৌরমন্ডলে। যারা সৌর দেবী শীহো’র পুত্র। প্রতিদিন তিনি তার একেকজন পুত্রকে সাথে করে তার রথে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতেন। একদিন তিনি নিয়মিত রুটিনে বিরক্ত হয়ে সকলপুত্রসহ একসাথে পৃথিবী পরিভ্রমণে বের হলেন। তাদের সম্মিলিত তাপে তখন পৃথিবীর অবস্থা ভয়াবহ রকমের কঠিন। গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে পৃথিবী সূর্যদেব ডাইজুনের কাছে সাহায্য প্রার্থণা করলো। ডাইজুন পৃথিবীর আর্জি শুনলেন েএবং তিনি সূর্যদেবী ও তাদের সন্তানদের শিক্ষা দেয়ার অভিপ্রায় নিলেন। একজন দক্ষ তীরন্দাজকে নিয়োগ দিলেন ডাইজুন। তীরন্দাজ তার মন্ত্রপূত তীর দিয়ে একে একে ৯ টি সূর্যকে হত্যা করলেন। একটি সূর্যকে তিনি মারতে পারলেন না। কারণ, ছোট্ট এক শিশু তার তীর চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলো বলে। আর, সেই থেকে পৃথিবী এক সূর্যের মাধ্যমে টিকে আছে।

৩। প্রাচীন ইজিপ্ট (মিশর)

পাতালপুরির যাত্রায় আমন রা’
সূর্য দেবতা রা’ মিশরীয় ইতিহাসে বেশ শক্তিশালী অবস্থানে আছেন। প্রাচীন ইজিপশিয়ান বর্ণনায় রা’কে ক্ষমতাবান ঈশ্বর হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। হায়ারোগ্লিফিকে ঈগল-মুখের আমন রাকে দেখে সহজেই সূর্যের অভিভাবক বলে চেনা যায়। তাকে শুভ শক্তির বাহক কিংবা অশুভের বিরুদ্ধের শক্তি মনে করা হয়। কিংবদন্তি বলে যে, তিনি ও তার সঙ্গীসাথীগন প্রতিদিন নৌকায় করে আকাশঙ্গা পাড়ি দেন। তারপর, রাতে ভ্রমণ করেন পাতালের জগতে, মৃতদের কাছে আলো পৌঁছে দেয়ার জন্য। এই পাতাল জার্ণি অনেক বিপদসংকুল। পাতালের সর্পদেবতা আ-পীপ তখন আমন রা’কে গিলে নেয়ার চেষ্টা করে। বলা হয়, যখন সূর্যগ্রহণ হয়, তখন পাতালের সর্পদেবতার কাছে আমন রা’ সাময়িকভাবে পরাজিত হন। কিন্তু, তিনি সবসময় আপীপকে ফাঁকি দিয়ে পাতাল থেকে বেরিয়ে আসেন। যার ফলে সূর্য আবার আলো ছড়ায় পৃথিবীতে।

৪। প্রাচীন গ্রীস (গ্রীস)

অগ্নিঘোড়ায় টানা অ্যাপোলোর আলোর রথ
গ্রীকরা বিশ্বাস করে, জিউসের পুত্র অ্যাপোলো প্রতিদিন অগ্নিঘোড়ায় টানা উড়ন্ত রথে করে আকাশ পরিভ্রমণ করেন। গ্রীক মিথলজিতে অ্যাপোলো শুধুমাত্র সূর্য-পরিচালক বা সূর্যদেবতা হিসেবেই নন, বরং তিনি সেখান আছেন সঙ্গীত ও সৌন্দর্যের দেবতা হয়ে। তিনি যুক্তি ও সুবুদ্ধির সাতে সাথে মানবতা উপহার দিয়েছেন সবাইকে। দিয়েছেন আলো ও সূর্যের উষ্ণতা, যা জীবনের সঞ্চারণ ঘটিয়ে টিকিয়ে রেখেছে পৃথিবীকে।

৫। ইনুইট সভ্যতা (গ্রীণল্যান্ড)

ইঁদুর বিড়ালের লুকোচুরি খেলা - ইনুইট সূর্য দেবতা
পৃথিবীর অনেক প্রাচীন কিংবদন্তির মতো ইনুইট ইতিহাসেও বিশ্বাস করা হয় যে, সূর্য ও চন্দ্র পরস্পর সহোদর। ভাইবোন। ইনুইটরা মনে করে, মালিনা হচ্ছে সূর্যদেবী আর আনিনজান হলো চন্দ্রদেবতা। তাদের মধ্যে একধরণের প্রতিযোগিতা কিংবা বিবাদ সবসময় থেকে যায়। মালিনা যখন আকাশ ভ্রমণে বের হয়, তার ভাই আনিনজান তাকে অনুসরণ করে। চেষ্টা করে ধরে ফেলতে। ফলে, দিনের পর রাত আসে। সূর্যের পরে আসে চন্দ্রের উপস্থিতি। ইনুইট বিশ্বাস অনুসারে, যখন আনিনজান তার বোন মালিনাকে ধরে ফেলতে সক্ষম হয়, তখনই সূর্যগ্রহণ ঘটে থাকে। এই সময়টুকু তাদের মহাকালীণ ভ্রমণের পথে একটু বিরাম ঘটালে আবার তারা তাদের নিয়মিত পথে ফিরে যায়।

৬। মাউরি সভ্যতা (নিউজিল্যান্ড)

সূর্যের গতি কমানোর আয়োজন - মাউরি সূর্য দেবতা
আমরা সূর্যের পথ ও প্রদক্ষিণের নিয়মিত একটি মাত্রা ভেবে নিয়েছি। ্আমরা মনে করি, সূর্য কালান্তর ধরে যেভাবে চলে আসছে, সেভাবেই চলতে থাকবে। মাউরিরা তেমনটি মনে করে না। তারা বিশ্বাস করে সূর্যের এই প্রদক্ষিণ কিংবা গতিপথ মোটেও সবসময় একরকম থাকে না। সূর্য আকাশজুড়ে ইচ্ছামতো চলাচল করে। ঘুরে বেড়ায়। মানুষের জন্য তখন খুব কষ্টকর সময় হয়। এবং, তখন আলোর অভাব দেখা দেয় পৃথিবীতে। এই অবস্থার অবসানে মাউই নামের একজন স্থানীয় যোদ্ধা দায়িত্ব নেয়। সে সূর্যকে ফাঁদে আটকানোর মতো যথেষ্ট পরিমাণের রশির ফাঁস তৈরী করে। এবং, সূর্যকে সেই জালে আটকে দিয়ে মাউইয়ের কোন এক পূর্বপুরুষের অস্থির হাড়ে বেঁধে রাখে। ততোক্ষণে সূর্য তার গতি কমিয়ে আনে এবং পৃথিবীতে নেমে আসে পর্যাপ্ত আলোর ধারা।

মানব সভ্যতার শুরু থেকেই সূর্য নানাভাবে মানুষের ভাবনা-বিশ্বাসকে প্রভাবিত করেছে। প্রানের অন্যতম উৎস হিসেবে প্রাণীজগত পেয়েছে সূর্যের উপস্থিতি। এইসকল প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ছিলো না। কিন্তু, তারপরও তারা সূর্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের ধরণে প্রায় সমপর্যায়ের অবস্থানে ছিলো। সকল সভ্যতাতেই ভিন্ন ভিন্ন রূপে সূর্য এসেছে মানুষের কল্যাণের অনুষঙ্গ হয়ে।

# তথ্যসূত্র ও সাহায্য কৃতজ্ঞতাঃ

১। এনশিয়েন্ট অরিজিন
২। এক্সপিডিয়া কানাডা
৩। ফটোবাকেট


লেখাটি পার্থিব নামে একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছিলো। সাইটটি বন্ধ হওয়াতে লেখাটি ব্যক্তিগত ব্লগে পোস্ট করা হয়েছে। ফিচার ইমেজটি পুরনো লেখার সাথে পাবলিশ হয়েছিলো।

Leave a Comment