মহারাষ্ট্রে পানি উন্নয়ন খাতে অর্থের বন্যা হওয়ার পরেও কেনো নদীগুলো ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে?
কৃষ্ণা নদীর ভাটিতে পি সাইনাথের একটি ভ্রমণ বৃত্তান্ত
তিনি সত্তরোর্ধ একজন স্ট্রবেরি চাষী। ওড়িষ্যা রাজ্যের পুরোনো মহাবালেশ্বরে নিজের ৩ একর জমিতে চাষাবাদ করেন। পানির প্রয়োজন মেটাতে পারিবারিক কূপ ছিলো নিজেদের। খরায় সেটি শুকিয়ে কুয়োর তলদেশ পাথরের মতো শক্ত হয়ে পড়ে আছে। তিনি ও তার স্ত্রী মিলে ব্যাপক পরিশ্রমে চাষ চালিয়ে যাচ্ছেন। কয়েক পুরুষ ধরে স্ট্রবেরি চাষ করছেন। ফলে তাদেরকে কষ্ট হলেও চালিয়ে নিতেই হয়। বড়ো কুয়ো ছাড়াও ছোট করে খুঁড়ে তৈরী ইঁদারা বা পানির গর্তে কিছু পানি এখনো আছে। তাই একভাবে হয়তো চলে যাচ্ছে তাদের দিন। নিজেদের স্বল্প পানির মজুত থেকে কিছু পানি তারা পাশের মন্দিরে দিয়ে দেন। কঠিন খরা তার রোজগার ব্যহত করলেও উদার আন্তরিকতাকে আহত করতে পারে নি। উনার নাম ইউনুস ইসমাইল নালাবান্দ। তিনি নিয়মিত কৃষ্ণামাই মন্দিরে নিজের ভাগের পানির অনেকটা অংশ আনন্দের সাথেই দান করেন। কৃষ্ণামাই সাতারা জেলার কৃষ্ণা নদীর উৎসমুখের বহুপ্রাচীন মন্দির।
“এই পানি কি আসলেই আমার? এই সবকিছুইতো মহান স্রষ্টার মালিকানাধীন। তাই না?” ইউনুসের কথার প্রেক্ষিতে তার ৭০ বছর বয়সী স্ত্রী রোশান নালাবান্দ সায় দিয়ে মাথা নাড়েন। তারা দু’জন নিজেদের খামারের পাকা স্ট্রবেরি ছোট ছোট বাক্সে সাজিয়ে রাখছিলেন। বাজারে পাঠাবেন। রোশান জানালেন, পাইকার-দালাল এসে মাল তুলে নিয়ে যাবে। এই বছর স্ট্রবেরি চাহিদা বেশি থাকায় দাম চড়া যাচ্ছে। নিজেদের কাজে ব্যস্ত থেকেই কথা বলছিলেন ইউনুস এবং রোশান দম্পতি। এবারের পানিশূন্যতা (খরা) তাদের দৈনন্দিন জীবনকে বেশ বড়ো রকমের ধাক্কা দিয়েছে। এক ফাঁকে রোশান আমাদের জন্য পানি ও হালকা নাশতার ব্যবস্থা করলেন। ব্যস্ততা কিংবা গ্রীষ্মের খরাপূর্ণ পরিস্থিতি মেহমানের আপ্যায়নে বাধা হয় নি।
নালাবান্দের গর্তের পানি না থাকলে কৃষ্ণামাই মন্দিরের ‘কুন্দা’ ( পানির টাংকি বা জলাধার ) খালিই পড়ে থাকে। এই মৌসুমে জলাধার খালি। কৃষ্ণামাই মন্দির – পর্যটন গন্তব্য পাঞ্চগানা মন্দির থেকে কয়েক মিনিটের হাঁটাপথ। পাঞ্চাগানা মন্দিরকে – কৃষ্ণা ও আরো চারটি নদী- কয়না, ভেন্না, সাবিত্রি এবং গায়ত্রী এর উৎস হিসেবে ধরা হয়। নদীগুলোর প্রকৃত উৎসমুখও খুব বেশি একটা দূরে নয় এখান থেকে। কৃষ্ণামাই মন্দিরটি পুরো ওয়েই-বালেশ্বর অঞ্চলে সম্ভবত সবচে পুরনো মন্দির। ছোট এবং সুন্দর এই মন্দিরটি স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে ‘নদী-মাতার ঘর’ হিসেবে পরিচিত।

আমি, আমার বন্ধু এবং সহকর্মী জয়দ্বীপ হার্দিকার আরো কিছু সাংবাদিকদের সঙ্গে এই অঞ্চলের কয়েকটি জেলা ঘুরে দেখেছি। মে মাসের গ্রীষ্মে আমরা মহারাষ্ট্রের অনেকগুলো নদীর প্রকৃত ও সিম্বলিক উভয় ধরণের উৎসমুখে ভ্রমণ করেছি। আমাদের পরিকল্পনা ছিলো, প্রকৃত উৎসমুখ থেকে নদীর ডাউনস্ট্রীম বা ভাটির দিকে যাবো। এই যাত্রাপথে স্থানীয় কৃষক, শ্রমিক এবং অন্য আরো যারা আছে তাদের সাথে আলাপ করবো। আমরা তাদের কথা শুনবো। সাধারণ ভূ-তাত্বিক খরার চেয়ে ব্যাপক প্রভাবক এই খরা কীভাবে দেখা দিলো, তাদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করবো। এবং, খরার কারণে তাদের জীবন-যাপনে কী ধরণের পরিবর্তন ঘটছে, সেসকল বিষয় জানার ইচ্ছা আমাদের ছিলো।

“গ্রীষ্মে নদীর কোন কোন অংশ শুকিয়ে যাওয়া খুব স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু, উৎসমুখ অঞ্চলেও আজকাল এই ঘটনা ঘটছে। এমনকি নদীগুলোর সবচে প্রশস্ত জায়গা শুকিয়ে খটখটে রূপ ধারণ করছে। যা এর আগে কখনোই হতে দেখা যায় নি। মহারাষ্ট্রের সুপ্রাচীন ও দীর্ঘজীবি নদীসমূহ রাতারাতি যেনো মৌসুমী নদীতে রূপ নিয়েছে।” ‘ওয়েস্টার্ন ঘাট ইকোলজি এক্সপার্ট প্যানেলের’ পরিচালক প্রফেসর মাধব গাডগিল এমনটি বলছিলেন। তিনি বলেন, “নদীর চলাচলের পথে বড়ো মাত্রার বাঁধ নির্মাণ কর্মকান্ড এবং অপরিকল্পিত জলাধার তৈরী এমন মহামারি আকারের খরার পেছনের অন্যতম প্রধান কারন।”
“গত ৬০ ধরে আমি কখনো কৃষ্ণামাইয়ের কুন্ড এমন শুকনো ও শূন্য দেখি নি।” স্থানীয় অধিবাসী নারায়ান জাঠ বলছিলেন। এই অঞ্চলের বার্ষিক বৃষ্টিপাতের হার ২০০০ মিলিমিটারের কাছাকাছি। অবসর নেয়া টুরিস্টগাইড এবং অভিবাসী শ্রমিক নারায়ান প্রায় সারাদিন মন্দিরের পাশেই বসে থাকেন। তিনি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করেন, এই খরার কারণ কেবল অনাবৃষ্টি নয়। অন্যকিছু এর জন্য সমানভাবে দায়ী। নারায়ান জাঠ মৌসুমী টুরিস্ট এবং বহিরাগতদের দোষী মনে করে থাকেন অনেকাংশে।
নারায়ন বলছিলেন, “বনায়ন ধ্বংস করা এই খরার পেছনের একটি কারণ। কিন্তু, স্থানীয়রা এটা করছে না। যদি আমাদের কেউ এখানে গাছের ডালপালাও কাটে, তাকে জেলে যেতে হয়। কিন্তু, বাইরের লোকজন এসে ট্রাকভর্তি করে কাঠ নিয়ে যায়। তাদের কেউ বাধা দেয় না।” তিনি আরো বলেন, ট্যুর গাইড থাকার সময় তিনি দেখেছেন, অনিয়ন্ত্রিত ট্যুরিজম ব্যপক ক্ষতি করে ফেলছে। চারদিকে রিসোর্ট এবং নানা রকমের নির্মাণকাজের প্রতিযোগিতা চলছে। ইট-পাথরের জঞ্জালে উপচে পড়ছে। প্রকৃতি থেকে সবুজ চলে যাচ্ছে কর্পোরেট টাকার কুমিরের পেটে। তিনি মনে করেন, কৃষ্ণামাই থেকে পাঞ্চগানা মন্দিরের পুরো এলাকা টুরিস্টদের উপচে পড়া ভিড় থেকে দূরে রাখতে হবে। সংরক্ষিত স্থান হিসেবে ঘোষনা করে এই ধ্বংস কিছুটা ঠেকানো যেতে পারে।

মন্দিরের উঠান থেকে তাকালে ‘ধম বালকাওয়াদি’ বাঁধের দৃষ্টিনন্দন একটি দৃশ্য দেখা যায়। বাঁধের ভেতরের জলাধারে এখনো কিছু পানি নজরে পড়ে। যদিও মৌসুমের এই সময়ে পানি আরো বেশি থাকার কথা ছিলো। বছরের পর বছর ধরে নানা ধরণের অপরিকল্পিত বাঁধ তৈরী ও কৃত্রিমভাবে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার ফলে এখানের ইকোসিস্টেমে বড়ো রকমের প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আজীবন সময় ধরে চলতে থাকা ‘লিফট ইরিগেশন’ (প্রাকৃতিকভাবে পানি প্রবাহের পরিবর্তে মোটরচালিত পাম্পের সাহায্যে পানি উত্তোলন পদ্ধতি) স্কিমের ধাক্কা। রাজ্যের ‘ইরিগেশন স্ক্যামের’ অন্যতম মূল অনুষঙ্গ হিসেবে এই স্কিমটি ভূমিকা রাখছে।
উচ্চমূল্যের এই ইরিগেশন স্কিমের হাত থেকে খুব কম সংখ্যক গ্রামই রেহাই পেয়েছে। কিন্তু, সাতারাতে জায়গীর কিংবা ‘তহসিলদারী’ (সরকারের আওতায় থেকে স্থানীয় জনগনকে শাসন করে একজন স্থানীয় শাসক। একইসাথে খাজনা আদায় করে। সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। জায়গীরদার বা নবাবী প্রথার মতো শাসন ব্যবস্থা। ) প্রথা প্রচলন আছে , এমন গ্রামগুলো কখনোই এর ফাঁদ থেকে বাঁচতে পারে নি। স্থানীয় ‘নের ড্যাম’ এবং ‘নের লেক’ এই জেলার পানির প্রয়োজন মেটানোর প্রধান উৎস। কিন্তু, এই অঞ্চলে অনেক গ্রাম ও সেই তুলনায় পানির সাপ্লাই অনেক কম। ফলে খাওয়া এবং ইরিগেশন কাজের কোনটিই ঠিকভাবে হয়ে উঠে না। অথচ, এই পানির বেশিরভাগ চলে যায় ‘নের ড্যাম’ এর কাছের ১৯ টি আখচাষী গ্রামে! কৃষ্ণামাই নদীর ৮০ কিলোমিটার ভাটিতে অবস্থান ‘নের ড্যামের’।
‘মান’ এবং ‘খাতাব’ ( মান ও খাতাব- স্থানীয় শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত একধরণের বিশেষ অঞ্চল। জমিদারির সাথে সাদৃশ্য আছে ) ছাড়াও আরো ১১ টি ভয়াবহ খরা-কবলিত ‘তহসিলদারী’ অঞ্চল রয়েছে। সাতারা, সাংলি ও সোলাপুর জেলার অধীনে এদের অবস্থান। এইসব তহসিলের জনগন প্রতিবছর ‘দুশকাল পরিষদ’ বা ‘খরা কাউন্সিল’ নামে একটি পরিষদ বা কমিটি গঠন করে। তারা চায় অন্যান্যা আরো প্রয়োজনীয় চাহিদার সাথে সাথে এই ১৩ টি ‘তহসিল অঞ্চল’ নিয়ে যেনো ‘মানদেশ’ নামে একটি খরা-কবলিত জেলা গঠিত হয়। একটি আলাদা খরা বিশেষায়িত জেলা। এমনটি বলছিলেন, ডাঃ মারুতি রামাকৃষ্ণা কাটকার। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা মেডিক্যাল অফিসার।
কাটকার আমাদের বলেন, “এই জেলাগুলোর বর্তমান প্রশাসন স্থানীয়দের সমস্যা সমাধানে মোটেও আন্তরিক নয়। কিন্তু, কীভাবে নতুন একটি জেলা এলাকাবাসীর প্রয়োজন পূরণে সহায়ক হবে? পুরনো জেলা-কর্তৃপক্ষ তাদের অন্যজেলায় চলে যেতে দেখে খুশি হয়! এবং তারা কিছু মনেই করে না! কারণ, তাহলে আর তাদের কোন দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের থাকে না!” খরা-কবলিত জেলা আন্দোলনের একজন নেতা, প্রফেসর কৃষ্ণা ইংগোলা ফোনে আমাদের তার আশার কথা জানালেন। তিনি বলেন, “এই অঞ্চল সমূহের মানুষদের সত্যিকারের প্রয়োজন এবং পানির অভাব তাদের সবাইকে একত্র করছে। জেলাকেন্দ্রিক এই একাত্মতা অদূর ভবিষ্যতে আন্দোলনকারীদের শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে ।
‘তহসিলদারী’ অঞ্চলগুলো সি-লেভেল থেকে প্রায় ১০০০ ফিট উচ্চতায় বৃষ্টি-ছাঁয়া বা রেইনশ্যাডো (বৃষ্টিপাত যেখানে হয় না বললেই চলে ) অঞ্চলে অবস্থিত। এখানে প্রতিবছর আমরা ৩০ দিনেরও কম বৃষ্টির দেখা পাই।পুরো এলাকাতে অভিবাসী লোকজনের সংখ্যা বেশি। সাধারণত তারা স্বর্ণকার এবং অলংকারের কারিগর হিসেবে কাজ করে। এই মানুষগুলো নিজেদের দক্ষতার মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ক্ষেত্রে বড়ো ভূমিকা রাখে।

এরকম পানির দুর্যোগ গত একবছর কিংবা ২ বছরের বিষয় নয়। এমনকি একটি ছোটখাটো খরা মৌসুমের বিষয়ও নয়। বরং বহু বছর ধরে তৈরী হয়েছে এই পরিস্থিতি। যার বেশিরভাগ মানুষের নিজের হাতের কর্মফল। কেনো এমন হচ্ছে? অবসরপ্রাপ্ত ইরিগেশন ইঞ্জিনিয়ার শারাদ মান্ডের সাথে পুনেতে আমাদের কথা হয়। এই সমস্যা সামলানোর কোন দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি আছে কিনা, জানতে চেয়েছিলাম। তিনি উত্তরে জানালেন, “একটি বাঁধের লাইফটাইম হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ বছর। পাইপলাইনের লাইফ হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ বছর। সবমিলে একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট টিকে ২৫ থেকে ৩০ বছর। সেখানে পাম্পিং মেশিনারিজ টিকে অন্তত ১৫ বছর। কিন্তু, একজন চীফ মিনিস্টার বা প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় থাকতে পারেন ৫ বছর। ফলে, দীর্ঘমেয়াদী চিন্তার কোন দাম এখানে নেই। চটজলদি যা করা সম্ভব, তাই করে দেখাতে চায় সব দলের লোকেরা। পরের চিন্তা পরে ভাবা যাবে, এই মানসিকতা এখানে সকলের। যার কারণে কোন কাঙিক্ষত পদক্ষেপের দেখা পাওয়া যায় না। ফলে , স্থানীয়দের জন্য প্রকৃতঅর্থে উপযোগী কোন পানি-উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়নও সম্ভব হয় না। ”
২০০০ সাল থেকে ২০১০ সাল, এই দশ বছরের দাপ্তরিক হিসেবে দেখা যায়, রাজ্যের ইরিগেশন পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে সর্বসাকুল্যে ০.১ শতাংশ। দশ বছরে ৭০ হাজার কোটি রুপি খরচের পর এই তথ্য বের হয়েছে! বিগত পাঁচ বছরে অনর্থক ও ক্ষতিকর ইরিগেশন স্কিমের দূর্নীতি বিষয়টি নিয়ে ‘চৈতালী কমিটির’ তদন্ত চললেও যে কোনদিন হয়তো সেটা বন্ধ হয়ে যাবে। মহারাষ্ট্রের প্রশাসনিক দপ্তর এবং রাইট টু ইনফরমেশন এক্সেসের দেয়া তথ্যানুসারে দেখা যায়, একটি ড্যামের নির্মাণ খরচ অর্ডার পাশ হওয়ার একমাসের মধ্যে ৫০০ শতাংশ বেড়ে যায়। আবার কখনো ছয়মাসের মধ্যে সে খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ১০০০ শতাংশে! গত ৩০ বছরে ৭৭ টির মতো প্রকল্প ‘নির্মাণাধীন’ রয়েছে। সবমিলে যে খরচের পরিমাণ, সেটার যোগফল ইন্ডিয়ার ছোট কয়েকটি রাজ্যের সম্মিলিত বাজেটের চেয়েও বড়!

ভূ-তলদেশের পানি ক্রমশ কমে আসছে মহারাষ্ট্রে। ৬৫ শতাংশ ‘ইরিগেশন’ গভীর ভূ-তলের পানির উপর নির্ভর করছে। অনেক দেরিতে হলেও ২০১৬ সালের এপ্রিলে রাজ্য সরকার ২০০ ফিটের নীচে পানির গর্ত খোঁড়া নিষিদ্ধ করেছে। এমনকি ভাবনার বিষয় এসে দাঁড়িয়েছে খাবার পানির ক্ষেত্রেও। কৃষ্ণা নদীর প্রবাহপথে এই সমস্যা জটিল রূপ ধারণ করছে প্রতিনিয়ত। অনেক বড়ো একটি অংশের পানি চলে যাচ্ছে কন্সট্রাকশন বা ইমারত/কারখানা নির্মাণ কাজে ব্যবহারের জন্য। এই সমস্যার পেছনের নিয়ামক হচ্ছে, গ্রামগুলোর শহরে রূপান্তরিত হওয়া এবং কৃষি সেক্টরের ইন্ড্রাস্ট্রিয়ালাইজেশন।
কৃষিক্ষেত্রেও সব ধরণের কৃষির পরিবর্তে বেশিরভাগ পানি আখচাষের মনোপলি বা একচেটিয়া দখলদারিত্বে চলে যাচ্ছে। ‘নের লেকের’ পানি খাবারের জন্য ব্যবহার হওয়ার কথা থাকলেও ফসলের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে নিয়মের বাইরে গিয়ে। মহারাষ্ট্রের দুই তৃতীয়াংশ আখচাষ হয় খরাপীড়িত অঞ্চলে। শারদ মান্ডে অভিযোগের সুরে বলছিলেন, “চিনির কারখানাগুলোর ব্যপারে কিছু বলা বারণ। কারণ, এসব আমাদের মহান এমএলএদের ফ্যাক্টরি। তারা নিজেদের খেয়াল খুশিমত যা ইচ্ছা করার ক্ষমতা রাখে এই রাষ্ট্রে”।
প্রতি একর আখের জন্য বছরে ১৮০ একর পরিমাণে পানির প্রয়োজন হয়। সাধারণ বৃষ্টিপাতের হিসাব অনুযায়ী যার পরিমাণ প্রায় ১৮ মিলিয়ন লিটার। অনেকে আবার বলে, আখচাষ কোন সমস্যা নয়। কারণ, এমনসব এলাকাতে আখচাষ হয়, যেগুলোতে পর্যাপ্ত পানি রয়েছে। খরা এলাকাতে আখের চাষ নেই। বিষয়টি মোটেও সেরকম নয়। আখ মাত্র ৪ শতাংশ জায়গায় চাষ হলেও এটি মহারাষ্ট্রের ‘ইরিগেশন’ করা পানির প্রায় ৭০ শতাংশ শোষণ করে। বলা যায়, ৪ শতাংশ আখের ফলন নিশ্চিত করতে রাজ্যের কৃত্রিম উপায়ে সংগৃহিত পানির প্রায় ৭০ শতাংশ খরচ হয়ে যায়।
আমাদের মহাবালেশ্বরের ইউনুস নালাবান্দের কথায় ফিরে যাই। তিনি বলছিলেন, “গত ৬০ বছরেও আমাদের কুয়ো কখনো শুকিয়ে যায় নি।” ইউনুস ও তার স্ত্রী তখনো তাদের স্ট্রবেরি প্যাকেট করে যাচ্ছিলেন। ইন্ডিয়ার প্রায় ৮০ শতাংশ স্ট্রবেরির উৎপাদন হয় মহাবালেশ্বরে। তারা আমাদেরকে কিছু স্ট্রবেরি এবং কালো মালবেরি ফল উপহার দিলেন। আমরা যেখানে বসে কথা বলছিলাম, সেখান থেকে সর্বোচ্চ ১০০ হাত দূরে কৃষ্ণামাই মন্দির। যে মন্দিরে ইউনুসের পরিবার মুফতে পানি দান করছে প্রতিদিন। আমাদের পেছনদিকে ৩ একর জমিতে তারা স্ট্রবেরি চাষ চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু, বলা মুশকিল কতোদিন পারবেন। ক্রমশ শুকিয়ে আসছে পানির মজুত। হয়তো সবকিছু শেষ হবে না। হয়তো বিটলসের গানের মতো করে বলা সম্ভব হবে, স্ট্রবেরি ফিল্ডস ফরেভার…।

( এই রচনাটি প্রসিদ্ধ সাংবাদিক পি সাইনাথের পারি নামক প্রোজেক্টের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রকাশিত Source of the rivers, scams of the rulers নামক একটি আর্টিকেলের অনুবাদ। অনুবাদের শিরোনাম অনুবাদক নিজের মতো দিয়েছেন। যদি কোন অংশ বুঝতে সমস্যা হয়, মূল লেখাটি দেখে নেয়া যেতে পারে। ব্যবহৃত ছবিগুলো পি সাইনাথের কপিরাইট সম্পত্তি। মূল লেখাটিও তাই। শিক্ষার উদ্দেশ্যে অনুবাদের চেষ্টা করা হয়েছে। যেকোন ধরণের গঠনমূলক আলোচনা-সমালোচন-মন্তব্যকে স্বাগতম! ভাষান্তরের অস্পষ্টতা ও ভুল-ভ্রান্তির দায় অনুবাদকের। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো। )