Hafizul Islam

শত নামের এক সীমান্ত-শহরে বিষণ্নতার অনুসন্ধান (ফটোগ্রাফি বিষয়ক অনুবাদ)

পড়েছেন: 1,321 জন পাঠক

এ্যালেক্স ওয়েব। বিশেষভাবে পরিচিত তাঁর ভিন্নধর্মী রঙিন ফটোগ্রাফিক সিরিজের জন্য। ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দীপপুঞ্জে কাজ করেছেন দীর্ঘসময় ধরে। প্রকাশিত হয়েছে ১৬ টি ফটোগ্রাফি বিষয়ক বই। নিউইয়র্কের এই ফটোগ্রাফার ১৯৮৯ সাল থেকে বিখ্যাত ফটোগ্রাফিক কো-অপারেটিভ ম্যাগনাম ফটোসের সাথে আছেন। তাঁর ফটোগ্রাফ/স্টোরি ছাঁপা হয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস ্ম্যাগাজিন, নেটজিও, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সহ আরো নানান পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে। ১৯৯৮ তে হেইজ্যালবাড গ্রান্ট ও ২০০৭ তে গুয়েনহেইম ফেলোশিপ লাভ করেন এ্যালেক্স। ওরহান পামুকের জন্মস্থান বিখ্যাত সীমান্ত-শহরে প্রথমবার এসেই প্রেমে পড়ে যান ইস্তাম্বুলের।

শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে ইস্তাম্বুল শহরের দেয়ালগুলো রক্ষা করে গেছে বহুমাত্রিক সভ্যতার পরিচতি। সময়ের প্রয়োজন আর কালের আহ্বানে এই শহর পাল্টে নিয়েছে নিজেকে বারবার। বাইজান্টিয়ম থেকে ডিউটেরা (নতুন রোম) তারপর কনস্টান্টিনোপল। ইস্তাম্বুলের দীর্ঘজীবন আর এখানকার অসংখ্য সড়কের মেলবন্ধন এ্যালেক্স ওয়েবকে অনুপ্রাণিত করেছে ভীষণভাবে। কয়েক বছরব্যাপি কঠিন অধ্যাবসায় আর কাব্যিক অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে তিনি তৈরী করেছেন একটি ফটোগ্রাফিক বই। স্থিরচিত্রের আর্কাইভ। তার নাম দিয়েছেন  ‘শত নামের শহর’ (City of a Hundred Names)

১৬ বছর বয়সে এ্যালেক্স প্রথম ইস্তাম্বুলে আসেন। সেইবারের ভ্রমণে তুর্কি এই প্রাচীন শহরের কিছু ছবি তোলার চেষ্টা করেছিলেন। তারপর ১৯৯৮ তে আবার ইস্তাম্বুলে ফিরেন এ্যালেক্স। এবারের প্রত্যাবর্তন ছিল তার জন্য ভিন্নরকমের। তিনি ইস্তাম্বুলকে অনন্য এক সীমানা-শহর হিসেবে আবিষ্কার করেন। যে শহর প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য, পূর্ব এবং পশ্চিমের মেলবন্ধন তৈরী করে রেখেছে। এশিয়া ও ইউরোপের মাঝখানে দু’টি ভিন্ন সভ্যতার ‘বৈঠকী ড্রইংরুম’ হিসেবে বহুকাল ধরে পালন করছে মেজবানের ভূমিকা। এই শহর একইসাথে ইসলাম ও ধর্মনিরপক্ষেতাকে ধারণ করে টিকে আছে বহুযুগ ধরে। ইউএস-মেক্সিকো বর্ডারে কাজ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা ওয়েবকে সাহায্য করেছিলো ইস্তাম্বুলকে নতুন করে চিনতে। সীমানা-শহরের সুগভীর অন্দরের একান্ত নিজস্ব জীবনধারাকে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন।

Alex Webb Street scene showing traditional Islamic dress and western style advertising. Istanbul, Turkey. 2001. © Alex Webb | Magnum Photos

তারপরের প্রায় ৭ বছর সময় ওয়েব কাজ করেছেন ইস্তাম্বুল নিয়ে । জমা করেছেন ইস্তাম্বুলের নানান বিষয়-আশয়। একইসাথে এই শহরেরর প্রতিটি অলি-গলি আর জমজমাট চায়ের স্টলের দৃশ্যমান ইনভেলপে ঢাকা ভিন্ন ভিন্ন অসংখ্য সংস্কৃতি, সেসবের বহুমাত্রিক বিশিষ্টতা তিনি দেখেছেন, লিখেছেন। ছবিতে ধরে রেখেছেন তাদের ছাঁপ। তুরস্ক যখন প্রথম মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র হিসেবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দেয়, তখন অনেক আশা-আকাঙক্ষার জন্ম হয়েছিলো তুর্কিতে।

সেই সময়ের ধারাবর্ণনা খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর সিরিজে।  কিন্তু, বর্তমানে দেশটি কঠিন এক রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পট পরিবর্তনের কাল অতিবাহিত করছে। দমবন্ধ করা থমথমে সময়ের মধ্য দিয়ে কাটছে এরদোয়ানের শাসনকালের তুরস্ক। তারপরেও ওয়েবের ব্ই এই শহরের অন্যএক চমকপ্রদ এবং আশাব্যঞ্জক জীবনের গল্প শোনায়।

আমরা এখানে কথা বলেছি ওয়েবের সাথে। ইস্তাম্বুল নিয়ে। ইস্তাম্বুলের সাথে তার অনুপ্রেরণা ও আগ্রহের সম্পর্ক তৈরীর জার্ণি তিনি আমাদের জানিয়েছেন।


Alex Webb View from a barbershop near Taksim Square. Istanbul, Turkey. 2001. © Alex Webb | Magnum Photos

ম্যাগনাম ফটোসঃ যখন আপনি প্রথম ইস্তাম্বুলে যান , তখন আপনার প্রথম অনুভূতি কেমন ছিলো?
এ্যালেক্স ওয়েবঃ ১৯৬৮ তে আমি প্রথমবার আমার পরিবারের সাথে ইস্তাম্বুলে যাই। ১৬ বছর বয়সে। ইউরোপের বাইরে ওটাই ছিলো আমার প্রথম কোন ভ্রমণ। আমার মনে আছে, আমি ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। একইসাথে প্রচন্ড আগ্রহও ছিলো। অদ্ভূত ধরণের চায়ের দোকান, মিনারে ভরপুর এই পরিবেশ আমার কাছে মোটেও পরিচিত কিছু ছিলো না। তারপর যখন আমি আবার ৩০ বছর পরে ইস্তাম্বুলে ফিরি, তখন আমার পুরোপুরি অন্যরকম অনুভূত হয়েছে।

ইউএস-মেক্সিকো বর্ডারে কয়েক যুগের ফটোগ্রাফির অভিজ্ঞতা আমার তখন হয়েছে। ইস্তাম্বুল আমার মধ্যে অন্যরকম এক আগ্রহের জায়গা তৈরী করে নেয়। এই শহরকে ভিন্ন এক বর্ডার শহর মনে হয়েছে। শহরটা যেনো প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মাঝে পার্থক্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পৃথক করে দিয়েছে ইসলাম এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে। উত্তরাধুনিকতা ও সুপ্রাচীনের ভিন্নতা নির্দেশ করছে সমান মাত্রায়। অন্যভাবে বললে একইসাথে ইস্তাম্বুল ধারণ করে আছে এইসকল সভ্যতার নানান অনুষঙ্গ।

ইস্তাম্বুল শহরের আঁকাবাকা রাস্তার গোলকধাঁধা আমার ভীষণ প্রিয়। একজন ফটোগ্রাফার হিসেবে এই অনুভূতি আমার আছে ‘পরিচিত গন্ডির বাইরে পা ফেলা’র মতো। ডানে কিংবা বায়ে , উঁচু হয়ে উঠে যাওয়া পথ কিংবা ঢালু সড়ক,  যেদিকেই আপনি যান , সেদিকই আপনাকে নতুন কোন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিবে। – এ্যালেক্স ওয়েব

 

Alex Webb On board a ferry at dusk near the Princess Islands.Istanbul, Turkey, 2001. © Alex Webb | Magnum Photos

ম্যাগনাম ফটোসঃ  আপনি ইস্তাম্বুলে অসংখ্যবার ফিরে এসেছেন। এই শহরে কী এমন আছে, যা আপনাকে বারবার ফিরিয়ে নিয়ে যেতো?
এ্যালেক্স ওয়েবঃ  ইস্তাম্বুল শহরের আঁকাবাকা রাস্তার গোলকধাঁধা আমার ভীষণ প্রিয়। একজন ফটোগ্রাফার হিসেবে এই অনুভূতি আমার আছে ‘পরিচিত গন্ডির বাইরে পা ফেলা’র মতো। ডানে কিংবা বায়ে , উঁচু হয়ে উঠে যাওয়া পথ কিংবা ঢালু সড়ক,  যেদিকেই আপনি যান , সেদিকই আপনাকে নতুন কোন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিবে।

তুলে ধরবে নতুন কোন দৃশ্য। যা প্রতিদিনই হয়তো নতুনভাবে তৈরী হয়। ইস্তাম্বুলের সড়ক-অলিগলি আমার কাছে আন্তরিক আর আতিথেয়তাপূর্ণ মনে হয়েছে সবসময়ই। অপরিচিত ফটোগ্রাফার হয়েও আমি চায়ের দাওয়াত পেয়েছি প্রায়শই। সম্পূর্ণ নতুন মানুষজনের সাথে তাদের বাড়ির আঙিনা কিংবা বারান্দায় বসে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়েছি। গল্প করেছি বিষণ্ন কোন এক সময়ের।

Alex Webb Street scene in Ayvansaray. Istanbul, Turkey. 2001. © Alex Webb | Magnum Photos
Alex Webb Street scene in Ayvansaray. Istanbul, Turkey. 2001. © Alex Webb | Magnum Photos

ম্যাগনাম ফটোসঃ  আপনিতো অনেকটা সময় কাটিয়ে দিয়েছেন ইস্তাম্বুলে। এখানকার কোন বিষয়টি আপনার কাছে একেবারেই নিজস্ব বলে মনে হয়েছে? যা হয়তো অন্য কোন শহরের নেই?
এ্যালেক্স ওয়েবঃ যতো বেশি সময় ধরে আমি ইস্তাম্বুলে থেকেছি, ততো বেশি আমি অনুভব করেছি , টার্কিশ সমাজ কতোটা জটিল রকমের হতে পারে। আর, এই জটিলতা সম্পর্কে আমি আসলে অনেক কমই জানি। যেমন বর্তমান টার্কিশ সমাজের কিছু বিরক্তিকর উন্নতির ব্যাপারে আমি ধারণা করতে পারি নি । সেসবের মধ্য রয়েছে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা (যা তুর্কিতে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় বিদ্যমান), ব্যক্তি স্বাধীনতকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রচেষ্টা বা প্যাকটিস।

ইস্তাম্বুল এক ভীষণ জটিল স্থান। যেখানে ইতিহাসের গভীরতা এবং বহুমাত্রিকতা একইসাথে তার বর্তমানের কথা বলে। – এ্যালেক্স ওয়েব

 

Alex Webb Asleep in Talabashi. Istanbul, Turkey. 1998. © Alex Webb | Magnum Photos
Alex Webb Asleep in Talabashi. Istanbul, Turkey. 1998. © Alex Webb | Magnum Photos

ম্যাগনাম ফটোসঃ  কেনো এই শহর আপনার ফটোগ্রাফিতে বেশ বড়ো একটা অনুপ্রেরণার জায়গা হিসেবে ভূমিকা রাখছে?
এ্যালেক্স ওয়েবঃ ইস্তাম্বুল একটি ভীষণ রহস্যময় আর জটিল স্থান। যেখানে ইতিহাসের গভীরতা এবং বহুমাত্রিকতা একইসাথে তার বর্তমানের কথা বলে। আমি ধীরে হলেও জানতে পারছি (সে জানার পরিধি ছোট হয়তো। ভিজ্যুয়াল মিডিয়ামে) ওরহান পামুকের ‘হুজুন’ এর অন্তর্নিহিত অনুরণন। অব্যাখ্যাত অন্যরকম সেই বিষণ্নতা, তীব্র বেদনা কিংবা অতল শূন্যতার অর্থ আমার আছে কিছুটা হলেও স্পষ্ট হয়ে আসছে। এই প্রকৃত অর্থে অনুবাদ-অসম্ভব শব্দটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সুতীক্ষ্ণ হাহাকারের কথা মনে করিয়ে দেয়। যেই শূন্যতার বসবাস কেবল ইস্তাম্বুলেই । ওরহানের জন্মভূমিতে।

 

Alex Webb Pigeon market, Istanbul, Turkey. 2001. © Alex Webb | Magnum Photos
Alex Webb Pigeon market, Istanbul, Turkey. 2001. © Alex Webb | Magnum Photos

ম্যাগনাম ফটোসঃ আপনি তুর্কির সাম্প্রতিক পরিবর্তনের খোঁজ রাখেন? আবার ফিরতে চান কখনো সেখানে?
এ্যালেক্স ওয়েবঃ পেছন ফিরে তাকালে আমার মনে হয়, যে সময়টুকু আমি তুরস্কে কাটিয়েছি, সেই সাত বছর তুর্কির ইউনিক এক ইতিহাসকে আমি ধারণ করতে পেরেছিলাম। সেই সময়  ওয়েস্টার্ণ ওয়ার্ল্ডের সাথে টার্কিশ সভ্যতার নতুন নতুন সম্ভাবনা দুয়ার খুলছিলো। সেই সময়কালেই তুরস্ক প্রথম মুসলিম দেশ হিসেবে  ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিলো। বর্তমানে সুদুর সম্ভবনার বিষয় হলেও যদি আমি ফিরে যাই আবার, নিশ্চয় অন্যরকম আরেকটা ইস্তাম্বুল এসে ধরা দেবে আমার কাজে। আমার ফটোগ্রাফে। আমার ভিজ্যুয়াল ক্যানভাসে।

আমি সবসময়ই বলি, যখন আমি কোন স্থান নিয়ে বই তৈরী করি। ছবি তুলি। তখন সে স্থান সম্পর্কে যে আবেগ-অনুভূতি কাজ করে,  পূনরায় সেখানে ফিরলে খুব কমসময়ই আগেকার মতো মনে হয়। সুতরাং আমি ইস্তাম্বুলে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছি না। অন্তত এই মুহুর্তেতো নয়ই। হয়তো ওরহানের সেই ম্যাজিক্যাল পেইন কিংবা অনন্য বেদনাকে অনুধাবনের মতো মন আমার আর এখন নেই। হয়তো। তবুও, কথায় আছে, ‘কখনোই শেষ বলো না’। কে জানে, আবার হয়তো কখনো ….


# পোস্টে ব্যবহৃত সকল ফটোগ্রাফ তুলেছেন এ্যালেক্স ওয়েব। সকল স্বত্ত্ব ম্যাগনাম ফটোসকর্তৃক সংরক্ষিত । # All Photos Used in This Post , Captured by Alex Webb. All Rights Reserver by Magnum Photos.

1 thought on “শত নামের এক সীমান্ত-শহরে বিষণ্নতার অনুসন্ধান (ফটোগ্রাফি বিষয়ক অনুবাদ)”

Leave a Comment