এখন অনেক রাত। দূর থেকে ভেসে আসছে রাতজাগা ডাহুকের আর্তরব। আমার জানালার পাশে দাঁড়ানো গাছটিতে, নীড়ে ফেরা কোন পাখিদের সামান্য আয়োজনের সংসার। আমি লিখছি কংক্রিটের শহর ঢাকা থেকে অনেক দূরের এক মফস্বল শহরের ছোট্ট এক বাড়িতে বসে। ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে ঝিমধরানো শব্দে। পৃথিবী ঘুমোচ্ছে নিশ্চিন্তে আকাশের গায়ে মাথা রেখে…। সুগভীর রাত্রির অতলান্তিক নৈঃশব্দ, প্রগাঢ় নিস্তব্ধতায় ঢেকে রেখেছে কর্মব্যস্ত আমাদের প্রাত্যহিক ছুটে চলার দৈন্য।
আমি যে বাড়িতে বসে লিখছি, তার পাশ দিয়ে অজানা কোন এক গন্তব্যে চলে গেছে পিচের রাস্তা…। সে রাস্তার শুরুটা আমার জানা থাকলেও তার শেষ কোথায় আমার জানা হয় নি। হয়তো কখনো হবে। কিংবা কখনোই জানা হবে না কোন সে মায়ায় পথ ছুটে গেছে অন্য কোন পথান্তরের তেপান্তরে। আমরা কতটুকুই বা জেনে উঠতে পারি জীবনকে.। শতসহস্র বছরের বৃদ্ধ, জীর্ণ হয়ে আসা, সময়ের ইজেলে আটকে থাকা জীবনকে , আবহমান জীবনের চলমান সেলুলয়েডের কতুটুকু আমরা জমিয়ে রাখতে পারি?
আমাদের সাধ্য কতটুকু..। চন্দনাকে আমরা ধরে রাখতে পারি নি। হাতে কালো বেল্টের রেডিয়াস ডায়ালের হালকা ঘড়ি হাতে দিয়ে কলেজের গেট পেরিয়ে চন্দনা আসতো আমাদের কাছে। রৌদ্রজ্জ্বল ভরন্ত গ্রীষ্মের দিনগুলোও ওর আলোয় ঝলমলিয়ে উঠতো..। আচ্ছা, ও কি সূর্যকন্যা ছিলো,,? জানি না। জানা হয়ে উঠে নি।
জীবনের অসংখ্য সমাধান অসম্ভব প্রশ্নগুলোর সংখ্যায় আরো একটি নতুন যোগ হলো। ওর হাসিটা ঠিক কতোটুকু সুন্দর ছিলো? ও কোন রঙ পছন্দ করতো? কী করতে পছন্দ করতো ও? কীভাবে কথা বলতো? ও কী কাউকে ভালোবাসতো? মামুন কিংবা অন্য কাউকে? জানি না। আমার কখনোই জানা হয়ে উঠবে না, ও দেখতে কেমন ছিলো..। আমার স্ক্রীণের চারপাশ জুড়ে তিনটি জোনাকী উড়ে উড়ে শীতল আলোর নরোম আলপনা আঁকছে…। চন্দনার বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো কলেজে থাকতেই।
ওর বর কী ওকে ভালোবাসে? ওর কী কখনো কান্না পায়? বুক ভেঙে কখনো হৃদয়ের রক্তক্ষরণ, চোখের জল হয়ে নেমে আসে কি অজস্র ধারায়? ওর কী কখনো মামুনের কথা মনে পড়ে? ওর বাসার ছাদ আছে কী? শ্রাবণের অঝোর বর্ষন, ওকে কী সেই আগের মতো আনন্দোচ্ছ্বল করে তোলে? বৃষ্টির রঙ কেমন হয়, আমি জানি না। তবে, আমার ভাবতে ভালো লাগে, চন্দনা দাঁড়িয়ে ভিজছে…ছাদের কার্ণিশে দাঁড়িয়ে ভিজছে একটি সাদাকালো একটি কাক। সারা শহর ভেসে যাচ্ছে বৃষ্টির রিমিঝিম ধারাজলে…।
চন্দনার ভেতরে সযতনে বন্ধুর জন্যে জমিয়ে রাখা ভালোবাসা জেগে উঠছে র্বষার প্রথম জলজ্যোৎস্নার সুকোমল স্পর্শে..। ওর হাসিতে ভাসছে আমার প্রিয় শহরের পথ-ঘাট। ভালোবাসা জাগিয়ে তুলছে ভালোবাসার রাজ্য..।ওর মেয়েটা দেখতে কেমন হয়েছে? ওর মতো? নাকি, ওর বরের মতো? ওর বাসায় কী এখন বারান্দা আছে? ওর খুব শখ ছিলো একটি বারান্দার। যেখানে বসে আমরা দু’জন মিলে, শীতের স্বল্পদৈর্ঘ্য বিকেলের ঘুমিয়ে পড়া দেখবো।
নিঃশব্দ পায়ে সন্ধ্যা নামছে চন্দনার চারপাশে। আকাশের বিস্তীর্ণ সামিয়ানা জুড়ে মিছিলে বেরিয়েছে দূরান্তরের কোন এক তারাদের দল..।