১৯৯৮ এর বন্যায় থই থই পানিতে ডুবে গেছে গ্রামের পর গ্রাম। চকিতে বসে ঘরের জানালা দিয়ে উঠানভর্তি পানি দেখি। বাতাসে জলের ঘ্রাণ। বিলের পাশে বাড়ি। হঠাৎ হঠাৎ দমকা বাতাস জলের উপর থিরথির নকশা কাটে। কোথাও যাওয়ার নেই। কিচ্ছু করার নেই। বাবার সরকারী চাকরির সুবাদে বেতনের টাকায় তখন দিন চলে যাচ্ছে। আমিরুল জ্যাঠা, রুকুদের বাড়িতে গোলাভর্তি চাল থাকলেও দিনকার সদাইপাতি থাকে না। নৌকা নিয়ে দিনে একবার বাজারে যায় বড়দের কেউ। সবার জন্য নিয়ে আসেন দরকারী সামান।
মাটির চুলা খাটের উপর বসিয়ে আমাদের রান্না হয়। একদিন দেখা গেলো, জ্বালানি শেষের পথে। কী বিপদ! তখন আমার সবচেয়ে প্রিয়, বড়মামা বেঁচে ছিলেন। একটা বড় কোষা নৌকা নিয়ে মা-বাবা ও পাশের বাসার এক কাকার সাথে আমি যাত্রা করলাম নানুবাড়ির পথে। রাস্তাঘাট সব পানির নীচে। পথ বলতে নৌকার মাঝিকাকার জানা অদৃশ্য কোন চলাচলের রেখা।
নানুবাড়িতে পানি প্রায় কোমরসমান। এরমাঝেই আদর আপ্যায়ন শেষে নৌকাভর্তি পাঠখড়ি নিয়ে আমরা ফিরছিলাম বাড়ির দিকে। চলতি রাস্তায় একটা বড় নদী পড়ে। নাম রসুলপুরের গাঙ। নদী পার হওয়ার সময় আমার যেরকম ভয় লেগেছিলো, অ্যাডভেঞ্চার অনুভব হয়েছিলো, চোখ বন্ধ করলে সেটা আমি এখনো হয়তো টের পাই।
বন্যা গেছে। আমি সাতার শিখেছি। ঢাকাতে পড়তে এসে আটকে পড়েছি ইদুর কলে। এর মাঝে একদিন জ্যান্ত ট্রাকের ধাক্কায় ফুঁসমন্তর ছাড়াই আমাদের নাগালের বাইরে চলে গেলেন প্রিয় আজিজ মামা। এরপর কতো জল গড়িয়েছি রসুলপুরের নদীতে। কতোশতবার নানুবাড়ি গিয়েছি। কিন্তু, কিছুই আর সেরকম ছিলো না। নেই। হয়তো থাকেও না। কিছু মানুষ আমাদের চারপাশে আনদেখা সম্পর্কের শক্ত জাল ছড়িয়ে যেতে থাকে। তারা নাই হয়ে গেলে শেকড় ছিঁড়ে নিয়ে চলে যায়। পড়ে থাকি আমরা, অসহায়।
অন্তরার সাথে আমার পরিচয়ের মুহুর্ত আমার মাথায় যে ফাইলে সেভ করা, সেটার থাম্বনেইল ইমেজে দেখা যায়, একজন রিনঝিন করে কথা বলতে থাকা মেয়ে, পানি খেতে চাইছে। এর আগের দিনও অন্তরাকে আমি পেয়েছি। কিন্তু, সেই ঠাণ্ডা পানির বোতল, মল চত্তরের পড়ন্ত দুপুর, পাশ দিয়ে চলমান গাড়িঘোড়া, মানুষের ভিড়..এই দৃশ্য প্রায় এক দশকেও মলিন হয়নি। এমন নয় যে, অন্তরার জন্য আমি নির্বিকারত্ব ছাড়তে পেরেছি। এমনও হয়তো নয় যে, আমাদের পথ অনিঃশেষ। তবুও, মাথার ভেতরে অজন্তা-ইলোরার দেয়ালে ছাঁপের মতো টিকে আছে সেইসময়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক ফেসবুক বন্ধু আছেন। জান্নাত। বাসন্তি রঙা শাড়িতে হাসিমুখ জান্নাতকে দেখতে শান্তি শান্তি লাগছিলো। প্রশংসা করতে গিয়েও থমকে গেলাম। মনে হচ্ছিলো, এভাবে ইনবক্সে কিংবা কমেন্টে কারো তারিফ করা এখনকার বিচারে অনুচিত হয়তো। এই থমকে দাঁড়ানো, এই দ্বিধা আমি ভয় পাই। প্রিয়জন, বন্ধু, পছন্দের কেউ কিংবা নিতান্ত অপরিচিত কারো প্রশংসা করতে গেলে আমরা কৃপণ ও কুটিল মানসিকতার হয়ে যাই কেন? আন্তরিক কোন প্রশংসা কি স্রেফ তারিফ হতে পারে না? এর পেছনে মতলব কি থাকতেই হবে!
অদ্ভূত একটা গোল পাকাচ্ছে মাথার ভেতর। ৯৮ এর বন্যা, অন্তরার ঠাণ্ডা পানির বোতলে আটকে থাকা সময়, আজিজ মামার অনন্তকালের জন্য ডুব, জান্নাতের বাসন্তি রঙা শাড়ি- সবকিছু একসাথে জট পাকিয়ে যাচ্ছে। ভাবছি, স্মৃতির ভল্টে একের পর এক জমানো ফোল্ডারগুলো কি নিয়মিত উল্টে দেখতে পারবো? উপচেপড়া বানের পানি কি কখনো আমায় নিয়ে যেতে পারবে বড়মামার টাইমলাইনে? অন্তরা কি নির্ভার হয়ে কখনো বাঁচা শিখবে?
সূতাছেঁড়া মুক্তোর মালার মতো গড়িয়ে পড়তে থাকে আমার প্রশ্নের টুকরো। কখনো লেফট-রাইট করে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায় ১৯৯৮ এর বর্ষাক্রান্ত ক্যালেন্ডারে।