Hafizul Islam

আইপিএ’র সাথে মোহাম্মাদ রাকিবুল হাসানের ফটোগ্রাফি বিষয়ক আলাপ

পড়েছেন: 1,018 জন পাঠক
© IPA, https://www.photoawards.com

মোহাম্মাদ রাকিবুল হাসান। বাংলাদেশী ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফার, ফটো সাংবাদিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট। জলবায়ু পরিবর্তন, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কট নিয়ে কাজ করেছেন। কেবল ভালো ছবি তোলার লক্ষ্যে পথ চলেন না। কাজের মাধ্যমে তিনি সামাজিক পরিমন্ডলে খানিকটা শান্তি আনার চেষ্টায় মগ্ন থাকেন। 

চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন হাসান। কিন্তু, তারপর তিনি বুঝতে পারেন, জাতির বিনির্মান ও সামাজিক পরিমন্ডলে একটি স্থিরচিত্র অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে। সেই থেকে আর কখনো তিনি পেছনে তাকান নি। হাসান আমাদের সামনে তুলে ধরেন বিষয়বস্তুর খুব সামনে থেকে নেয়া কোন নৈকট্যের গল্প। যেসব দৃশ্য কিংবা মুহুর্তের কাছে পৌঁছানো আমাদের পক্ষে অসম্ভব। তিনি আমাদের দৃষ্টিশক্তির প্রতিনিধিত্ব করেন। কখনো আবার হয়ে উঠেন আমাদের অনুভবের মাধ্যম।

এবছর (২০১৮) তার ফটোসিরিজ  আই এ্যম রোহিঙ্গা (I am Rohingya) এর জন্য তিনি আইপিএ ডিসকভারি অব দ্যা ইয়ার , ২০১৮ (IPA DISCOVERY OF THE YEAR, 2018) পুরস্কার জিতেছেন। আমরা কথা বলেছিলাম তার সাথে। এই আলাপে উঠে এসেছে রাকিবুল হাসানের ফটোগ্রাফিক জার্ণির নানান অনুষঙ্গ।

IPA INTERVIEWS WITH WINNING PHOTOGRAPHERS সিরিজের অন্তর্ভূক্ত, মোহাম্মাদ রাকিবুল হাসানের সেই সাক্ষাৎকারের বাংলা অনুবাদ আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। আশা রাখছি, তার জার্ণি হয়তো কোন ভবিষ্যৎ ফটোগ্রাফারকে অনুপ্রাণিত করবে।  মূল সাক্ষাৎকারটি ইংরেজিতে এখানে পাবেনমূল প্রজেক্টটি দেখতে পাবেন এখানে। (এই আর্টিকেলে ব্যবহৃত ফটোগ্রাফারের ছবির কপিরাইট IPA এর। এবং, ফিচার ইমেজে ব্যবহৃত ছবির কপিরাইট ফটোগ্রাফারের।)


আইপিএ: আইপিএ বিজয়ী প্রোজেক্ট “আই এ্যম রোহিঙ্গা”র পেছনের গল্প বলুন। ভাবনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা জানতে চাই
এম.আর. হাসান:
আই এ্যম রোহিঙ্গা প্রোজেক্টটি আমাকে এবারের আইপিএ প্রতিযোগিতায় ডিসকভারি অব দ্যা ইয়ার পুরস্কার এনে দিয়েছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির জাতিগত গণহত্যা নিয়ে গল্পটি (ফটোসিরিজ) তৈরী। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি যুগ যুগ ধরে মায়ানমারে বসবাস করে আসছে। কিন্তু, তারা মিয়ানমানের প্রশাসন ও সমমনাদের জাতিভেদগত সহিংস আচরনের স্বীকার হয়েছে নানান সময়ে। এমন অবস্থা অনেকদিন থেকে চলে আসলেও শেষ পর্যন্ত এবার প্রায় ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা, জীবনের তাগিদে বাংলাদেশে মাইগ্রেট করে।

২০১৭ সালে যখন মাইগ্রেশন শুরু হয়, তখন থেকেই আমি এই ঘটনার দৃশ্যধারণ করতে শুরু করি। মাথাগোজার ঠাঁই লাভের আশায় বাংলাদেশের ভূমিতে শরণার্থী হিসেবে রোহিঙ্গা জনগনের গণঢলের আমি একজন সাক্ষী। বেশিরভাগ মানুষই ছিলো খালি পা, শূন্য হাত। এবং তাদের পিঠে নিজেদের বয়োবৃদ্ধ মা-বাবা ও আত্মীয়-পরিজনদের বহন করে আনছিলো। এই বয়োবৃদ্ধদের ১০০ মাইলের বেশি পথ পায়ে হাঁটার সাধ্য ছিলো না। রোহিঙ্গাদের এই জার্ণি ছিলো সত্যিকার অর্থে ভীষণ কঠিন। তাদেরকে চড়তে হয়েছে অগুনতি পাহাড়-পর্বত। সাগরের জলে তাদের ভাসতে হয়েছে ছোট নৌকা কিংবা ট্রলারের সাহায্যে। নিজেদের ভূমি ছেড়ে পালানোর সময় তাদের অনেকেই মায়ানমার আর্মির গুলিতে সেখানেই মৃত্যুবরণ করেছে। পরবর্তীতে আমি নিয়মিত পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করেছি যে, কীভাবে তারা শরণার্থী শিবিরের নতুন জীবনের সাথে খাপ খাওয়ায়..।

আইপিএ: দেশান্তরের এই ঘটনা পর্যবেক্ষণের সময় আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কেমন ছিলো? সেই সময়ের বিশেষ কোন স্মৃতি কি আছে?
এম.আর. হাসান: আমি যখন মায়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থান করছিলাম, তখন আমি আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড়ো দেশত্যাগের ঘটনা দেখি। ম্যাগনাম ফটোগ্রাফার রাঘু রায়ের একগুচ্ছ সাদাকালো ছবির কথা আমার মনে পড়ছিলো। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ-পাকিস্তান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার যেসব ছবিতে তিনি বাংলাদেশি শরণার্থীদের দেশত্যাগ ও ইন্ডিয়ায় আশ্রয় গ্রহণের সময়কালকে ধারণ করেছিলেন ।

তখন আমি সিদ্ধান্ত নিই যে, পূর্ববর্তী ঐতিহ্য অনুসরণে করে, আমার গল্পের প্রাথমিক ছবিগুলো হবে সাদাকালো। যাতে করে আমি চারপাশে ঘটতে থাকা মানবিক বিপর্যয়ের তীব্রতার সারমর্মটুকু প্রতিফলিত করতে পারি আমার কাজের মধ্য দিয়ে। আমি এখনো কিছু ঘটনা স্মরণ করতে পারি। কোন একদিন আমি রোহিঙ্গাদের এক ভিড়াক্রান্ত স্থানে হাজির হই। যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা তাদের হাতে বানানো অস্থায়ী ক্যাম্প নির্মাণ করছিলো।

আমি তখন নূরজাহান বেগম নামের একজন নব্বইউর্ধ্ব বৃদ্ধার কাছে যাই। তিনি মিয়ানমানের বুথিডাউং থেকে বাংলাদেশে আসার পথে পাঁচদিনের রাস্তা পাড়ি দিয়েছেন। তাদের গ্রামেও জাতিগত শুদ্ধি-অভিযান বা গণহত্যা চলেছিলো। আমি তার কাছে জানতে চাই, তিনি এখন কেমন বোধ করছেন। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, তিনি জ্বরে ভুগছেন। আমি যখন কোথাও ছবিতোলার কাজে যাই, তখন আমার সাথে প্রাথমিকভাবে দরকারি ঔষধপত্র থাকে। আমি তাকে ঔষধ ও একবোতল পানি দিই। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বারবার জানতে চাইছিলেন, তাদের শরণার্থী ক্যাম্পের আশেপাশে কোথায় তিনি মেডিক্যাল সুবিধা পেতে পারেন। আমি তখন ভাবছিলাম, তার অবস্থানে থাকলে আমি কী করতাম!

আইপিএ: পরিবর্তনের শক্তি হিসেবে ভিজুয়াল ইমেজ কেমন ক্ষমতাশীল বলে আপনি মনে করেন?
এম.আর. হাসান: সারা বিশ্ব রোহিঙ্গা সংকট, তাদের দেশত্যাগ ও এর ফলে সৃষ্ট  নির্মম ট্রাজেডি সম্পর্কে জানতে পেরেছে সাংবাদিকদের ধারণ করা ছবির মাধ্যমে। মায়ানমার আর্মি ও তাদের দেশের সরকারের ভয়ংকর কর্মকাণ্ড দেখে মানুষজন এই ভীতিকর ঘটনা সমন্ধে সচেতন হয়েছে। ভিজুয়াল নিউজ বা ছবিসহ সংবাদ প্রকাশের পরপরই অনেক সাহায্যকারী সংস্থা দ্রুতসম্ভব শরনার্থী শিবিরে সাহায্য প্রেরণের কাজ শুরু করে দিয়েছিলো। কোন বার্তা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে মাধ্যম হিসেবে ফটোগ্রাফি তর্কাতীত ভাবেই ক্ষমতাশীল।

কিম পাক (Kim Puc) এর ছবি বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার মাধ্যমে পুলৎজার পুরস্কারজয়ী ফটোগ্রাফার, নিক ওঠ (Nick Ut) ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভয়বহতা কমিয়ে আনতে ভূমিকা রেখেছিলেন। প্রযুক্তির উন্নতির এই সময়ে ইমেজ এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম। পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে কোন দূরপ্রান্তে ছবি পৌঁছে দিতে মুহুর্ত সময়ই বর্তমানে যথেষ্ট। একটি ইমেজ যতো প্রকাশিত ও প্রচারিত হবে, যতোবেশি দর্শক সেটি দেখবে, সমাজে তার প্রভাব ততো বেশি হবে। এবং, আইনপ্রণেতাদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পরোক্ষভাবে বাধ্য করবে।

আইপিএ: এবার, আমরা একটু আপনার অতীত থেকে ঘুরে আসতে চাই। যখন আপনি প্রথম ক্যামেরা  হাতে নিয়েছিলেন এবং আপনি অনুধাবন করেছিলেন যে, ফটোগ্রাফি আপনার আবেগের জায়গা হয়ে উঠবে, সেই মুহুর্তের কথা আমাদের বলুন।
এম.আর. হাসান: আমি একজন অনুভূতিপ্রবণ মানুষ। আমি পৃথিবীকে বিপুল সম্ভাবনার বলেই অনুভব করি। এটি একটি চিত্রপট, একটি ক্যানভাস; যেখানে আমরা সবাই অংশ নিই। সবার ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা রয়েছে। প্রত্যেকের একান্ত নিজস্ব গল্প আছে। প্রতিটি গল্প নানাদিক থেকে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত। আমরা একেকটি ভৌগলিক অঞ্চলে বসবাস করি।  যা আমাদের জীবনের প্রেক্ষাপট হয়ে উঠে। আমি যখন ইউনিভার্সিটি অব সিডনীতে ফিল্মমেকিং বা চলচ্চিত্রনির্মাণ বিষয় নিয়ে পড়ছিলাম, তখন আমি ফটোগ্রাফি শুরু করি।

আমার একটা এসাইনমেন্ট ছিলো। যেখানে ফটোগ্রাফের সাহায্যে গল্প বলতে হতো। আমি সেসময় সিডনী অপেরা হাউস অতিক্রম করছিলাম। হঠাৎ আমি আবিষ্কার করি যে, অপেরা হাউসের উপরের নৌকার পালের মতো অংশে কোন একটা কিছু হচ্ছে। যেটা ছিলো মূলত একটি যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের অংশ। আমি ফিল্ম ক্যামেরা দিয়ে ছবিটি তুলি এবং  ডিজিটাল মাধ্যমে স্ক্যান করে নিই। পরবর্তীতে আমি ছবিটির মূল নেগেটিভটি হারিয়ে ফেলি। ড.উইল স্যান্ডার্স  (Dr. Will Saunders)এবং ডেভিড বার্জেস (David Burgess) নামের দু’জন আন্দোলনকারীকে সেই ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়। অপরাধ ছিলো, অপেরা হাউসের পালতোলার মতো অংশে তারা “নো ওয়্যার” শব্দটি এঁকে দিয়েছিলেন। তাদের ৯ মাসের জেল ও একইসাথে অপেরা হাউস ট্রাষ্ট কৃর্তপক্ষের অনুকূলে, ক্ষতিপূরণ বাবদ $১৫১,০০০ ডলার (১কোটি ২৭ লক্ষ ৯৯ হাজার ৫১৫ টাকা ?) জরিমানা প্রদানের জন্য অপরাধীদের উপর নির্দেশ জারি করে আদালত।

আমি পরবর্তীতে অনুধাবন করতে পেরেছিলাম, গণমাধ্যম ও বিকল্প নানা মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে একটি ছবি কতোটা ক্ষমতাশীল ও স্মরণীয় হয়ে উঠতে পারে। শেষপর্যন্ত আমি একজন ফুলটাইম ফিল্মমেকার হওয়ার পরিবর্তে একজন ফুলটাইম ফটোগ্রাফার হয়ে উঠলাম। যদি একটি স্থিরচিত্রকে  আমি  যথাযথ গুরুত্ব ও কার্যকর অর্থ না দিতে পারি, তাহলে কিভাবে আমি গতিশীল ও প্রাণবন্ত ছবির সিরিজ তৈরী করতে পারবো? যাইহোক, আমি এখন আমার ক্লায়েন্টের চাহিদা এবং নিজের ব্যক্তিগত আগ্রহে একইসাথে স্টিল ছবি (ফটোগ্রাফি) ও মোশন ভিডিও (ভিডিওগ্রাফি) দুটোরই কাজ করি।

আইপিএ: আপনার ফটোগ্রাফির ক্যারিয়ার শুরুর সত্যিকারের মুহুর্ত সম্পর্কে আমাদের বলুন
এম.আর. হাসান: আমার ফিল্ম স্কুলের পড়াশোনার শেষ করার পর আমি ফটোগ্রাফার হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। আমি কখন নিয়মিত আমার মাতৃভূমি বাংলাদেশে ভ্রমণ করতে শুরু করেছি। যা দেখি সেটাই আকর্ষণীয় মনে হয়। সেসবের ছবি তুলি। পরবর্তীতে আমি ম্যানিলা ইউনিভার্সিটিতে ফটোজার্নালিজমের উপর পোস্ট-গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা করার জন্য ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো থেকে ফুল-ফান্ডেড স্কলারশীপ পাই। ম্যানিলার পরে আমি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে হিস্টোরি অব আর্টসের উপর একটি সার্টিফিকেট প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছিলাম।

আমি বর্তমানে ইংল্যান্ডের ফলমাউথ ইউনিভার্সিটিতে ডিসটেন্স-লার্ণিং প্রোগ্রাম বা দূর-শিক্ষণ কার্যক্রমের মাধ্যমে এমএ ইন ফটোগ্রাফিতে পড়ছি। এসকল একাডেমিক প্রোগ্রাম আমার ভিজুয়াল লিটারেসি বা দেখার দক্ষতাকে সমৃদ্ধ করেছে। একইসাথে আমাকে দিয়েছে চমৎকার রকমের থিওরিটিক্যাল ও প্র্যাকটিক্যাল (তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক) ধারণা, পেশাদারিত্বের বোধ এবং দক্ষতা; যেগুলোর সমন্বয়ে আমি আরো যথার্থ ও পরিশীলিত উপায়ে ফটোগ্রাফির চর্চা করতে পারি।

আইপিএ: আপনার তোলা সবচে সংকটময় ছবির কথা আমরা শুনতে চাই
এম.আর. হাসান: ২০১৪ সাল চলছে। বাংলাদেশে বিরোধীদল তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থাপনায় নতুন করে নির্বাচনের দাবীতে রাস্তায় নেমেছে। নির্বাচন পূর্ববর্তী ও নির্বাচন পরবর্তী সময়ে তারা প্রায়ই নিয়মিতহারে ধর্মঘট-অবরোধ ডাকছে। পাবলিক বাস, ট্রেনসহ অন্যান্য গণপরিবহনে পেট্রোল বোমা, ককটেল এবং বিভিন্ন দাহ্য পদার্থ মেরে জ্বালিয়ে দেয়ার মতো ঘটনা অহরহ ঘটছিলো। সেসব হামলায় নিরপরাধ ও নিরীহ সাধারণ জনগন আহত ও নিহত হচ্ছিলো।  রাজনৈতিক দলগুলো তখনো নিরীহদের উপর ধ্বংসাত্মক এইসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোন দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে পারে নি। আমি সেইসময় নিয়মিত হাসপাতালে যেতাম। পোড়া ও আহত রুগীদের ছবি তুলতাম। সেটা আমার জন্য ছিলো এক ভয়াবহ ট্রমা বা মানসিক আঘাতের সময়। আমাকে চারপাশে মৃত মানুষের লাশ পড়ে থাকার করুণ দৃশ্য দেখতে হতো। তাদের আত্মীয়দের কান্নার শব্দ সারাক্ষণ কানে বাজতো।

পরবর্তীতে আমি ২০১৫ সালে নেপালের ভূমিকম্পের ঘটনা কভার করেছি। সেই ভূমিকম্পে প্রায় ১০ হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। আমি তখন নিজের কাছে প্রশ্ন করতাম এবং প্রকৃতির এমন নিষ্ঠুরতার পেছনের কারণ জানতে চাইতাম। আসলে এর কোন উত্তর আমার কাছে ছিলো না। স্রষ্টার উপস্থিতি ও ধর্মের কার্যকারিতা নিয়ে তখন আমার সংশয় জাগে।

আইপিএ: অপরিচিতদের সাথে – বিশেষ করে যারা দুর্বল অবস্থানে আছে, তাদের সাথে কথা বলা, অনেক ফটোগ্রাফারের জন্য জটিল হয়ে উঠে। আপনি কীভাবে আপনার সাবজেক্ট (মূলত মানুষ) এর সাথে যোগাযোগ তৈরী করেন?
এম.আর. হাসান: অনেকক্ষেত্রে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে শারীরিক অঙ্গভঙ্গিমা (বডি জেশ্চার) ও চেহারার অভিব্যক্তি  (ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন) এর সাহায্যে যোগাযোগ করেছি। যখন কোন একটি স্থানে সংকট-সংঘর্ষ-লড়াই ঘটতে থাকে, তখন আমার কারো সাথে কথা বলার দরকার নেই। কিন্তু, যখন পরিস্থিতি স্তিমিত ও শান্ত হয়ে আসে এবং ক্ষতিগ্রস্থ (ভিকটিম) এর আশেপাশে তাদের ছাড়া আর কেউ থাকে না তখন প্রশ্ন করার মাধ্যমে তাদের বিরক্ত করা খুব মুশকিল কাজ হয়। একজন ফটো-জার্নালিস্ট হিসেবে, সর্বোচ্চ-ভালো-মুহুর্তের জন্য অপেক্ষা করার চেষ্টা করি; যখন আমার সাবজেক্ট কথা বলতে তুলনামূলক স্বস্তি বোধ করবে।

আইপিএ: যখন কোন সংঘাতের ছবি তোলা হয়, তখন আপনি  কি নিজেকে কোন একপক্ষের সাথে সংযুক্ত মনে করেন? নাকি নিউট্রাল বা নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকেন?
এম.আর. হাসান: আমি সব বিষয়, ঘটনা এবং অভিজ্ঞতাকে একটি নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে দেখি। আমি কোন পক্ষ অবলম্বন করি না। আমি শুধু ঘটনার গতিপ্রবাহ অনুসারে অগ্রসর হই, নিজেকে পরিচালনা করি। যদি সেখানে কোন ক্ষতিগ্রস্থের জীবন রক্ষার জন্য সাহায্য দরকার হয়, তখন অবস্থার তাৎক্ষণিক বিশ্লেষণ , আমার করণীয় বেছে নিতে সাহায্য করে।

আইপিএ: যখন কোন এসাইনমেন্টে বের হন, জরুরী কী কী সামগ্রী আপনি সাথে নিয়ে থাকেন?
এম.আর. হাসান: কোন এসাইনমেন্টে বের হওয়ার আগে আমি সবসময় আমার গিয়ার ও এগুলোর কার্যকারিতার বিষয়টি চেক করি। ক্যামেরা ব্যাগে আমি বেশকিছু জিনিস বহন করি; যেমন, রেইন প্রোটেক্টর, পোর্টেবল হার্ডড্রাইভ, মিনি ল্যাপটপ, জরুরী ঔষধ, নোটবুক, কলম এবং ব্লোয়ার। সবচে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে আমি সবসময় আমার মোবাইল ফোন এবং পাওয়ার ব্যাংক আমার সাথে নিয়ে থাকি। আমি মোবাইলেও ছবি তুলি; এটা আমাকে আমার এসাইনমেন্ট বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত কোন জরুরী ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করতে সাহায্য করে।

আইপিএ: ফিল্ডে থাকাকালীন আপনার ক্যামেরা সেটিংস কী থাকে?
এম.আর. হাসান: আমি এপারচার প্রায়োরিটি ও শাটার প্রায়োরিটিতে ছবি তুলি। প্রথম ১/২ টা ছবি তোলার পর আমি তখন সিদ্ধান্ত নিই যে, ছবির জন্য এক্সপোজার বাড়ানো-কমানোর প্রয়োজন আছে কিনা।

আইপিএ: পোস্ট-প্রসেসিং এর জন্য আপনি কোন ধরণের টুলস ব্যবহার করেন? আপনার কাজের ধারা সম্পর্কে বলুন।
এম.আর. হাসান: আমি ফটোশপ সিসি এবং এর সাথে নিক কালেকশনের মতো কিছু প্লাগিনস ব্যবহার করি। পোস্ট-প্রসেসিং এর ক্ষেত্রে সবসময় ফটোজার্নালিজমের ইথিক্যাল স্ট্যান্ডার্ড বা নৈতিক মাত্রাগত অবস্থান মেনে চলি।

আইপিএ: এই বছরের (২০১৮) আইপিএ ডিসকভারি অব দ্যা ইয়ার জেতার বিষয়টি কেমন লাগছে?
এম.আর. হাসান: আই এ্যম রোহিঙ্গা প্রজেক্টের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও চমৎকার অর্জন। এর ফলে দর্শকদের কাছে আমার প্রজেক্টটি আরো বিস্তৃত পরিধিতে পৌঁছে গিয়েছে। এই স্বীকৃতি আমাকে ভিজ্যুয়াল জার্নালিজম নিয়ে আরো আত্মবিশ্বাসের সাথে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করবে।

আইপিএ: ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফিতে আপনি কী শিখেছেন?
এম.আর. হাসান: আমি একটি বিষয় শিখেছি। সেটা হচ্ছে, ভিজ্যুয়াল আর্ট এবং ফটোগ্রাফি বিষয়ে আমার আগ্রহ অপরিসীম। এবং এটি একটি আকর্ষণীয় ক্যারিয়ার- যা আমাকে গতানুগতিক চাকরীর ঝামেলা থেকে মুক্তি দিয়েছে। এটি একইসাথে আমার মধ্যে এই অনুধাবনও তৈরী করেছে যে; খুব বড়ো আকার ও প্রকারে না হলেও, সমাজের কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্তত নিজের কাজের মাধ্যমে আমি শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারবো।

Leave a Comment