ভবেরচর বাজার রোডের একটি প্রি-ক্যাডেট স্কুলে ক্লাস ২ তে পড়তাম তখন। আমাদের স্কুল রাস্তার পাশেই। টিনশেডের একতলা ঘরে। গ্রামে তখনও কিন্ডারগার্টেন স্কুলের চল শুরু হয় নি। প্রতিদিনের যাতায়াত ছিলো খুব ছোট্ট একটা স্কুল ভ্যানে। গাদাগাদি করে বসতাম আমরা ৮/৯ জন।
ভ্যান প্রায়ই আসতো না। তখন হেঁটে ফিরতে হতো বাড়িতে। সেই সময় থেকেই আমার মধ্যে একটা অভ্যাস গড়ে উঠলো..। রাস্তায় খুব মনোযোগ দিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে হাঁটতাম। চোখ কুঁচকে মাথা একটু নামিয়ে নিয়ে তারপর চলতাম। এভাবে হাঁটলে রোদের মধ্যেও সব খুটিনাটি দেখতে পেতাম।
রাস্তার চারপাশের ফেলে দেয়া অসংখ্য রঙচঙে কাগজের প্যাকেট ছিলো আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। প্রাণের জুস পাওয়া যেতো তখন ৬ টাকার প্লাষ্টিক বোতলে। জুসের সেই খালি বোতল কুড়িয়ে, পরম যত্নে স্কুলব্যাগে তুলে নিতাম। মির্জাপুর চায়ের হলুদ কাগজের ঠোঙা, বিদেশি চকলেটের প্যাকেট, নতুন কোন খেলনার মোড়ক, ঈগলু আইসক্রীমের কাঠের বাট এইসব হাবিজাবিতে ব্যাগ বোঝাই করে বাড়ি ফিরতাম।
মা প্রতিদিনই খুব বকাঝকা করতেন। পাড়া-পড়শিরা বলতো, পোলাটার মাথায় সমস্যা আছে। টোকাইগো মতন সবকিছু টোকাইয়া লইয়া আসে..। বাবার চোখের দিকে তাকালে দেখতাম, শব্দহীন সমর্থন ফুঁটে আছে আমার প্রতি। কেনো তখন বাবা আমাকে সমর্থণ করতেন, জানি না। তবে, এখন মনে হয়, বাবা বুঝতে পারতেন তার হাবলুমার্কা ছেলেটা কিছু খুঁজছে..। হয়তো সেজন্যই তিনি কখনো বাঁধা দেন নি।
মোড়কের বিভিন্ন ছবি, রঙিন ডিজাইন, প্যাকেটের হরেক রকমের তৈরীকৌশল তখন আমাকে খুব আকর্ষণ করতো। কোন প্যাকেটে দেখতাম ইংলিশের পাশাপাশি চাইনিজ অক্ষরের লেখা। কোন প্যাকেটে দেখতাম বিদেশি কোন শহরের ঠিকানা..। ভিন্নতার নানা বিষয় ছিলো এই হরেক রকমের প্যাকেটের প্রতিটিতে।
আমি দেখতাম, কী উপাদান দিয়ে বানানো হয়েছে চকলেটটি। কী কী লেগেছে এই বিস্কিট কিংবা কেক তৈরীতে। একদিন হঠাৎ খেয়াল করলাম, বেশিরভাগ প্যাকেটে এক্সপায়ার নামে একটা ডেট লেখা থাকে। শব্দটি উচ্চারণের ক্ষমতা তখনও গড়ে উঠে নি আমার। অর্থ জানারতো প্রশ্নই নেই।
একদিন বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম এটার অর্থ। বাবা সেদিন বলে দিয়েছিলেন…। সাথে এটাও জানিয়েছিলেন, মানুষ মারা গেলে নাকি মেডিকেলেও এই একই শব্দে নোটিশ দেয়া হয়…। সেদিন অদ্ভূত লেগেছিলো আমার কাছে। মনে হয়েছিলো, চকলেট-বিস্কিটের মতো মানুষও কি মারা গেলে নষ্ট হয়ে যায়!
ছোটবেলার সেই অভ্যাস এখনো আমার সাথে রয়ে গেছে। আমি যখন রাস্তায় হাঁটি, আমার পাশে অদৃশ্য হয়ে ছোটবেলার সেই টোকাই নীরব এখনো আমায় সঙ্গ দেয়। আমি হাঁটি আর দেখি..। রাস্তার বিলবোর্ডের রঙচঙা নারী, দামী দামী আসবাবপত্রের ছবি, সৃজণশীল প্রচারণা কিংবা বিরক্তিকর এ্যাড..সব দেখি আমি গভীর মনোযোগে..। দেখি দোকানপাটের সাইনবোর্ড, রাতের শহরে ঝলমলে নিওন বাতি, খসেপড়া ব্যানার..। অসংখ্য সব ব্যানার-সাইনবোর্ডে টাকা উড়তে দেখি আমি আর আমার বন্ধু টোকাই নীরব।
পণ্যের পাশাপাশি এই দ্রুত অপৃসয়মান সমাজ মানুষকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে পণ্যের কাতারে। দিপীকা পাড়ুকোণের লাস্যময়ী ভঙ্গি কিংবা জোনাকী সিনেমা হলের রগরগে সিনেমার পোষ্টার দেখে তৃপ্ত হওয়ার কী বিচিত্র চেষ্টা আপাতভদ্র মানুষ এই আমাদের!
ছোটবেলার সেই টোকাই নীরব কোন্ অজানা গুপ্তধণের খোঁজে জমাতো অসংখ্য মোড়ক, আজ আর তা মনে করতে পারি না। তবে, বুঝতে পারি, সেদিনের খোঁজ আজও শেষ হয় নি।
এই নাগরিক সময়ে এসেও আমি আর টোকাই নীরব ঘুরে বেড়াই ঠাঁসবুনোটের ভালোবাসাহীন কংক্রিট নগরীতে..।
আমরা খুঁজি..। টোকাই অজানা কিছু..। হয়তো আমাদের ভেতরের অতৃপ্ত কোন বাসনার খোঁজ করি..। কিংবা খুঁজি মনভালো করে দেয়া কোন হাসি..। সাদামনের মানুষ..। নিজের অক্ষমতা লুকোনোর মতো কোন নির্জণ ঘরের কোণ..। কিংবা খুঁজি ভালো থাকা নামের অদৃশ্য কোন অনুষঙ্গ..।
==============
## ভবেরচর মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া থানার একটি স্থান
শেষের কথাগুলো ভালো লেগেছে; চমৎকার ইতি টেনেছো। আর তুমি মুনশিগঞ্জের ছেলে জেনে ভালো লাগলো!
জন ভাই দেখি নিয়মিত আসছেন! ভালো লাগছে জেনে, কেউ অন্তত আসে পড়তে আমার ছাইপাশ লেখা..:) আমি আপনি দেশিভাই 🙂
দারুন লিখেছেন ,চালিয়ে যান…
কষ্ট স্বীকার করে পড়া এবং মন্তব্য করা, দু’টোর জন্যই ধন্যবাদ। আবার আসার আমন্ত্রণ রইলো। ভালো থাকবেন। 🙂
সত্যিই শেষের
কথাগুলো ভালো
লেগেছে;
চমৎকার ইতি
টেনেছো। শেষের দিকে