Hafizul Islam

যান্ত্রিক সময়ের ৫ টি মানবিক গল্প ও আমাদের রোবট না হওয়ার প্রমাণ

পড়েছেন: 927 জন পাঠক

চারপাশের অসংখ্য দুঃসংবাদ আপনাকে হতাশ করে দিচ্ছে? প্রতিদিনই হয়তো ভাবেন, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু, আসলে কি তেমন হচ্ছে? এই কঠিন সময়েও এমন অনেককিছুই ঘটে, যে কাহিনীগুলো আমাদের আশা বাঁচিয়ে রাখে। আজকে এমন কিছু গল্প নিয়েই লিখছি।

ফরিদপুরের সেই সামাদ চাচার কথাতো আপনি জানেনই, যিনি ৪৮ বছর ধরে প্রতিদিন একটি করে গাছ লাগিয়ে চলেছেন। কিংবা যশোর সদর উপজেলার কৃষ্ণবাটি গ্রামের ভ্যানচালক শহীদুলের কথা, যে তার ক্ষুদ্র আয়ের একটি বড়ো অংশ খরচ করেন এলাকার দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠের সামগ্রী কিনতে।

আজকের গল্পগুলো আমাদের পরিচিত গন্ডির বাইরে হলেও এই গ্লোবাল ভিলেজেরই অন্য গোলার্ধের।

দুই স্কুলপড়ুয়ার বর্ণবাদহীন পৃথিবী

যখন আমাদের চারপাশ বর্ণবাদের ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠছে, তখন আমেরিকার এক স্কুলে অন্যরকম এই গল্পের শুরু। রেড্ডি ওয়েলডন এবং জ্যাক্স রোজবাশ পাঁচ বছর বয়সী। কেনটাকির এক ছোট্ট টাউনে তাদের বাস। জ্যাক্স তার মাকে একদিন বললো, মা, আমি আগামী সপ্তাহে স্কুলে যাওয়ার আগেই চুলের স্টাইল পাল্টাতে চাই। মা অবাক হয়ে বললেন! কেনো! তুমি সেদিন নতুন করে চুল কেটে আসলে! জ্যাক্স বললো, আমি তাহলে স্কুলে যাবোই না।

মা কিছুটা বিস্মিত হয়ে চিন্তা করছিলেন, কী এমন হলো যে, চুল কাটাতে চাইছে। অথচ, ওকে সেলুনে নেয়াই যায় না। মা জানতে চাইলেন কেমন স্টাইলে চুল কাটাতে চায় জ্যাক্স। সে তখন বলরো, আমার চুলের কাট আমি রেড্ডির মতো করে করতে চাই। যাতে আমাদের চেহারা দেখতে একইরকম লাগে। তাহলে শিক্ষক আমাদের আলাদা করতে পারবে না।

জ্যাক্স এর এই চিন্তায় একটি খুঁত কিংবা অসম্ভব সমস্যা ছিলো। রেড্ডির গায়ের রঙ কালো। তার পরিবার আফ্রিকান-আমেরিকান। আর জ্যাক্স এর গায়ের রঙ সাদা। রেড্ডির গায়ের রঙের কারণে তাকে জ্যাক্সের থেকে আলাদা করে ফেলে সবাই। এটা জ্যাক্সের ভালো লাগে না। কারণ, রেড্ডি তার সবচে প্রিয় বন্ধু।

কী অবাক ব্যাপার! তাই না? এই পৃথিবীতে বর্তমানে রেসিজম কিংবা বর্ণবাদের প্রকট প্রকাশ না থাকলেও আছে কঠিনরকমের শক্ত গোপন চর্চা। একজন সন্তানের রঙ তার মর্যাদা, তার সামাজিক অবস্থানে প্রভাব ফেলে। আমাদের সমাজে একজন মেয়ের জন্য সাদা রঙের বাইরে অন্যকোন রঙের হওয়া যেনো অপরাধ! এমন এক জন্মগত অপরাধ, যার উপরে মেয়েটির দায় নেই। কিন্তু, তাকে সেই অপরাধের বোঝা বহন করে যেতে হয় আমৃত্যু।

এমন এক কঠিন পৃথিবীতে ছোট্ট দুই স্কুল পড়ুয়া বন্ধুর পরস্পরের প্রতি আত্মিক টান আমাদের অবাক করে। কালারব্লাইন্ড এই শিশুদের পৃথিবীতে মানুষই সবশেষ কথা। এখানে বর্ণবাদের অনুপ্রবেশ নেই। কী দারুন, তাই না?

ক্যান্সার আক্রান্ত স্ত্রীকে নতুন করে প্রপোজ

আপনি যদি শোনেন , একজন ব্যক্তি ২৬ বছর ধরে যে নারীর সাথে সংসার কারছে, তাকে পূণরায় তিনি প্রপোজ করেছেন। তখন অবাক না হয়ে পারবেন?

যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপি নদী তীরের ছোট্ট এক শহর লোয়া। সেখানে দুই সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে সুখের সংসার জিম কোচের। ৬০ বছর বয়সী এই ভদ্রলোক তার ৫৪ বছর বয়সী স্ত্রী লরা কোচকে ২৬ বছর সংসার করার পর আবার নতুন করে প্রপোজ করেছেন।  কেনো জানেন? কারণ, লরাকে নতুন করে তাদের ভালোবাসার কথা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য। লরার তখন ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়ে।

লরা বলছিলেন, ক্যান্সার আপনার জীবনের অনেককিছুই হয়তো পাল্টে দেবে। হয়তো আপনি নাও ফিরতে পারেন জীবনের কাছে। তবুও আপনার অনেককিছুই থাকবে, যেগুলো আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেবে যে, আপনি বেঁচে আছেন। আপনার এমন এক জীবন ছিলো, যেখানে আপনার জন্য ভালোবাসার মানুষেরা ছিলো। আমার স্বামী আমাকে সেই জীবনের চিত্রই আবার আমার সামনে নিয়ে এসেছে। এই কঠিন সময়ে যা আমাকে অনুপ্রেরণা দেবে।

জিম তার ছেলে ক্রিস্টিয়ানকে নিয়ে হিরের আংটি কিনে এনেছিলেন। তারপর কোন এক সুন্দর মুহুর্তে তিনি তার ক্যান্সার আক্রান্ত স্ত্রীকে নতুন করে প্রপোজ করেন। জীবন কী দারুন অসাধারণ!

যে ছেলেটি নির্ভরতার প্রতীক হয়েছিলো বন্ধুর জন্য

কুইন ক্যালেন্ডার। ৭ বছর বয়সী এই শিশুটি দাঁড়িয়েছিলো একটি ছোট্ট দোকান নিয়ে। যেখানে সে লেমনেড বিক্রি করার চেষ্টা করছিলো। কেনো তার লেমনেড বিক্রি করতে হবে? তার বাবা-মা কি তার ভরণপোষণ করছে না?  না। সেজন্য কুইন লেমনেডের দোকানদারি করছিলো না। সে দাঁড়িয়েছিলো তার বন্ধুর জন্য।

ব্রাইডেন গ্রজডানিশ তার বন্ধু। সেরেব্রাল পালসি নামের এক জটিল রোগে আক্রান্ত। ব্রাইডেনের চলাফেরায় অনেক কষ্ট হতো। কুইনের ভালো লাগে নি এই কষ্ট। সে চেয়েছিলো, যাতে ব্রাইডেনের কষ্ট একটু কমে। তাই, কুইন তার পরিবারের সহায়তা নিয়ে স্থানীয় এক গ্রোসারি শপ (মুদি দোকান) এর সামনে তার লেমনেড বিক্রির দোকান শুরু করে। যেখানে কুইন এবং ব্রাইডেন দু’জনে মিলে চমৎকার স্বাদের লেমনেড বিক্রি করতো।

কুইন ক্যালেন্ডারের মা তার ছেলের এই হৃদয়গ্রাহী কাহিনী একটি ডোনেশন ওয়েবসাইটে পোস্ট করেছিলেন। তার মনে হয়েছিলো, হয়তো তাতে কিছু বাড়তি টাকা আসবে। কিন্তু, সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রায় ৬১ হাজার ডলারের ডোনেশন জমা হয় ব্রাইডেনের চিকিৎসার জন্য। বছর শেষে যে টাকা ব্রাইডেনের অপারেশনে অনেক অবদান রেখেছে।

এইসব দারুন কিছুরই শুরু হয়েছিলো কুইন নামে ছোট্ট এক শিশুর অনেক বড়ো হৃদয়ের ছোট্ট এক স্টেপ বা পদক্ষেপের উপর ভর করে।

বেবিসিটারও কখনো গার্ডিয়ান এ্যাঞ্জেল হতে পারে

এমন কাউকে আপনি কখনো কোন অর্গান ডোনেট করেছেন, যার খুব প্রয়োজন ছিলো? কিংবা, কখনো রক্ত দিয়েছেন মুমূর্ষু কোন রোগীকে? কিয়ের্স্টেন মাইলস একজন প্রফেশন্যাল বেবিসিটার। তালিয়া নামের এক শিশুর দায়িত্ব নিয়েছিলেন ২০১৬ সালের এক গ্রীষ্মে। তালিয়ার দায়িত্ব নেয়ার পরপরই মাইলস জানতে পারেন, তালিয়ার লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করাতে হবে। না হলে হয়তো তালিয়া আর বেশিদিন বাঁচবে না।

মাইলস তখন আর কোনকিছু চিন্তা করেন নি। তিনি তালিয়ার ডোনার হতে রাজি হয়ে যান। ২০১৭ সালে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তালিয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়। এবং দুজনেই সুস্থ হয়ে উঠে। তালিয়ার মা-বাবা বিশ্বাস করেছিলেন যে, মাইলস তাদের পরিবারে তালিয়াকে বাঁচানোর জন্যই এসেছিলো। আমরা যদি তোমাকে যতোদিন বেঁচে আছি, প্রতিদিনই ধন্যবাদ জানাই, কৃতজ্ঞতা পোষণ করি, সেসবকিছুই যথেষ্ট হবার নয়। তুমি সত্যিকারের রূপকথার গার্ডিয়ান এ্যাঞ্জেল।

বিমানবন্দরের অচেনা সাহায্যকারী

প্রতিটি বন্দরই ভীষণ ভিড়বাট্টা আর মানুষের চাপ থাকে। নতুন কেউ অন্য শহরের বিমানবন্দরে গেলে এমনিতেই ভড়কে যেতে পারে। কখনো কোন গেইটে তার বিমানের লাইন, কোত্থেকে বোর্ডিং পাস নিতে হবে, ব্যাগ সংগ্রহের লাইন কোনটা এই সবকিছুই রীতিমতো ঝামেলার।

এই ভীতি আরো বেড়ে যায়, যখন একেবারেই অনাকাঙক্ষিত কিছু ঘটে। এমনই এক ঘটনা ঘটেছিলো এক বাবার সাথে। তিনি যখন এয়ারপোর্টে তার ফ্লাইটের জন্য চেক ইন করলেন, তখন তাকে বলা হলো যে, তার দুই বছর বয়সী বাচ্চার জন্য আলাদা টিকেট কিনতে হবে। তিনি ধারণা করেছিলেন, বাচ্চাটি তার সাথে ফ্রিতেই ভ্রমণ করতে পারবে। টিকেটের দামও যথেষ্ট বেশি। ৭৫০ ডলারের মতো।

লোকটির কাছে টাকা না থাকায় বাচ্চাটিকে কাউন্টারের কাছে রেখে তিনি ফোনে টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করছিলেন। এমন সময় কাউন্টারে একজন মহিলা এসে জানালেন যে, তিনি বাচ্চাটির টিকেটের টাকা দিচ্ছেন। কাউন্টার ম্যানেজার তার নাম জানতে চাইলে তিনি তার নাম গোপন রাখার অনুরোধ করে টিকেটের টাকা পরিশোধ করে দিলেন। শিশুটির বাবা কাউন্টারে ফিরতে তাকে জানানো হলো, তার মেয়ের টিকেট কেনা হয়ে গেছে।

তখন বাবা জিজ্ঞাসা করলেন কে তার টাকা পরিশোধ করেছে..। কাউন্টার ম্যানেজার মহিলার পরিচয় জানাতে অপারগতা প্রকাশের পর শিশুটির বাবা ভীষণ অবাক হলেন। একইসাথে তিনি অজ্ঞাতপরিচয়ের মহিলাটির জন্য আন্তরিক শুভ কামনা জানালেন। তার মনে হয়েছিলো, স্বয়ং ঈশ্বর তাকে সাহায্য করেছেন হয়তো। কোনভাবেই সেদিন জানা সম্ভব হয়নি সেই অচেনা সাহায্যকারীর পরিচয়। তবুও এই ঘটনা আমাদের আশাবাদী করে।

পৃথিবীজুড়ে এখন চলছে ধ্বংসের সময়। উন্নত হচ্ছে প্রযুক্তি। বাড়ছে জীবনমানের মিথ্যা আশ্বাস। মানবতার সুকোমল মনোবৃত্তি হারিয়ে যাচ্ছে জীবন থেকে। যান্ত্রিক সভ্যতার সাতে তাল মেলাতে গিয়ে ক্রমশ যন্ত্রে রূপ নিচ্ছি আমরা। এই কঠিন সময়েও এমন অসংখ্য মানবিক ও হৃদয়ছোঁয়া ঘটনা ঘটে চলেছে সবুজ এই গ্রহের নানা জায়গায়।

মানুষের টিকে থাকা প্রমাণ করছে নানান চেহারার এইসকল কাহিনী। আমাদের মনে করিয়ে দিয়ে যায়, মানুষ এখনো রোবট হয়ে যায় নি। আমাদের বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখে অচেনা মহামানুষগুলো। যারা নিজেদের সীমিত সামর্থের মধ্যে থেকেও অসাধারণ সব কাজ করে যাচ্ছেন শুধুমাত্র হৃদয়ের টানে।

আন্তরিক শ্রদ্ধা রইলো মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসা সেইসব অচেনা হিরোদের জন্য।


লেখাটি পার্থিব নামে একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছিলো। সাইটটি বন্ধ হওয়াতে লেখাটি ব্যক্তিগত ব্লগে পোস্ট করা হয়েছে। ফিচার ইমেজটি পুরনো লেখার সাথে পাবলিশ হয়েছিলো।

Leave a Comment