ফটোগ্রাফ, পেইন্টিং, স্কেচ কিংবা ড্রইংয়ের কোন গভীরতা থাকে না! আসলেই কি তাই? সত্যিকার অর্থে ব্যপারটা সেরকমই। ভিজ্যুয়াল আর্টের এই মাধ্যমগুলো দ্বিমাত্রিক। দৈর্ঘ্য , প্রস্থ থাকলেও কোন তল নেই। ফটোগ্রাফি বলতে বুঝায়, একটি ত্রিমাত্রিক পৃথিবীর দ্বিমাত্রিক অনুলিপি কিংবা হুবহু কপি। আমাদের চোখ ও মস্তিস্কের ইমেজিং প্রক্রিয়ার বহুমাত্রিক সক্ষমতার কারণে আমরা কাঙিক্ষত বস্তুর দূরত্ব ও স্থানিক অবস্থান পরিমাপ করতে পারি। যার মাধ্যমে সেই বস্তুর ত্রিমাত্রিক ভিশন আমাদের মস্তিস্কে ডিকোড হয়।
গভীরতা উপলব্ধির এই যোগ্যতা ক্যামেরার নেই। একইভাবে পেইন্টিং কিংবা ড্রইংয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। কিন্তু, ভিজ্যুয়াল আর্টের কারিগরেরা কখনোই এই সীমাবদ্ধতাকে সহজভাবে নেন নি। ফ্রাঁ এঞ্জেলিকো, ম্যাসাসিও, ম্যান্টেগনা, লিঁও বাতিস্তা আলবার্তে ও লিউনার্দো ভিঞ্চিসহ রেঁনেসা যুগের আরো অনেক পেইন্টারের অন্যতম আগ্রহের বিষয় ছিলো এই গভীরতার বিভ্রম কিংবা ইল্যুশন অব ডেপথ।
ইল্যুশন অব ডেপথ কিংবা গভীরতার বিভ্রম বিষয়টি একধরণের অপটিকাল ট্রিকস। দৃষ্টিগত চাতুর্য। আমরা যখন কোন ছবি দেখি, সেখানে অনেক ধরণের অবজেক্ট কিংবা বস্তুর ছবি অথবা উপস্থিতি থাকে। বাস্তবে সেসব বস্তুর অবস্থান এক জায়গায় কিংবা একসারিতে নয়। প্রতিটির নিজস্ব দূরত্ব ও অবস্থানিক ভিন্নতা রয়েছে। কিন্তু, দ্বিমাত্রিক হওয়ার কারণে এই দূরত্ব আমরা ধরতে পারি না।
ফলে বস্তুগুলোর কোন গভীরতা আমরা বুঝতেও পারি না। কিন্তু, বাস্তবে আমাদের চোখ বস্তুগুলোর দূরত্ব ও অবস্থানের হিসাব করে একটি ত্রিমাত্রিক কিংবা থ্রিডি ছবি আমাদের মস্তিস্কে পাঠায়। এই যে গভীরতা না থাকায় আমরা ভিন্ন ভিন্ন বস্তুর অবস্থানকে সমান্তরাল দেখছি, একই রকম লাগছে আমাদের কাছে এটাই ইল্যুশন অব ডেপথ। আমরা একটি উদাহরণ দেখি। তাহলে সহজে ব্যাখা করা যাবে।
উপরের ছবিটিতে ফোরগ্রাউন্ডের ঘাসের ছোট ছোট ঝোপগুলোকে দূরে অবস্থিত পাহাড়ের চেয়ে বড়ো মনে হচ্ছে। একজন দর্শকের কাছে মনে হতে পারে , সে আসলে কিছু দানবাকৃতির ঘাসের ঝোপ এবং কঠিন চাপে ছোট করে ফেলা পাহাড়ের সারি দেখছে। আবার সে এটাও মনে করতে পারে যে, ঘাস ও পাহাড় নিজেদের আসল আকৃতি ও স্বাভাবিক মাপমতোই আছে।
কিন্তু, যেহেতু পাহাড়ের সারি অনেক দূরে, তাই দেখতে এমন ছোট লাগছে। আর ঘাসের ঝোপ যেহেতু কাছে তাই খুব বড়ো দেখাচ্ছে। এই যে ভাবনার ভিন্নতা যখন তৈরী হয়, তখনই সৃষ্টি হয়ে গভীরতার বিভ্রম বা ইল্যুশন অব ডেপথ। এই ইল্যুশন বা বিভ্রমকে আমরা গভীরতার কল্পনাও বলতে পারি।
ছবিটিতে কোথাও বলা নেই যে, ঘাস এবং পাহাড়ের সাইজ বা পরিমাপ নিয়ে কী সিদ্ধান্ত দর্শক নেবে। কিন্তু, আমরা সবাই ধরেই নিই যে পাহাড় ও ঘাসের সাইজ সাধারণই আছে। দূরত্বের কারণে দেখতে এমন লাগছে। এই দূরত্ব এখানে দৃষ্টির বিভ্রম তৈরী করছে। আমাদের চোখে ত্রিমাত্রিক উপস্থাপন বা থ্রিডি রিপ্রেজেন্টশনের অনুভূতি দিচ্ছে।
কয়েক শতক ধরেই শিল্পীরা দ্বিমাত্রিক শিল্পকর্ম যেমন পেইন্টিং, ড্রইংয়ে গভীরতার বোধ তৈরীতে নানা ধরণের পদ্ধতি উদ্ভাবন করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এসকল পদ্ধতি আবিস্কারের পূর্বে পেইন্টিং ছিলো কোন ধরণের গভীরতাবোধহীন। প্রাচীন গুহা পেইন্টিং নিয়ে চিন্তা করলে বিষয়টি আমরা বুঝতে পারি। তখনকার আর্টে কোন গভীরতার ধারণা ছিলো না। তাই, দেখতে সমান ও সাধারণ দৃশ্য বা লাইনটানা কিছু বিষয় মনে হয় সেসব শিল্পকর্ম।
আপনি প্রথম শতাব্দির কোন ইউরোপিয়ান পেইন্টিং দেখার চেষ্টা করেন, দেখবেন তাতে উপস্থিত বিভিন্ন অবজেক্ট কিংবা বস্তুর অবাস্তব সাইজ ও অগোছালো বিন্যাস। দুই ফুট কাছের মানুষ আর মাইলখানেক দূরের মানুষের সাইজ কিংবা পরিমাপ তাতে সমান মনে হবে। এখানেই প্রয়োজন হয় ইল্যুশন অব ডেপথের। গভীরতার বিভ্রম আবিস্কার এই অবাস্তব পরিমাপের জটিলতার সমাধান করে।
যে টেকনিক কিংবা পদ্ধতিগুলোর সহায়তায় একটি সমান্তরাল ভূমি কিংবা অবস্থানে কিংবা সারফেসে থ্রিডি রিপ্রেজেন্টেশন তৈরী করা যায় সেগুলো সম্পর্কে কিছুটা জানার চেষ্টা করা যাক।
ওভারল্যাপিং ও লেয়ারিং
যখন ভিজ্যুয়াল আর্টের ফ্রেমে কোন বস্তু সেখানে উপস্থিত অন্য আরেকটি বস্তুর উপর ওভারল্যাপ করে বা তার উপরে অবস্থান নেয় তখন একধরণের ইল্যুশন তৈরী হয়। আমরা ঢেকে যাওয়া বস্তুটিকে দূরের মনে করি। আর যে বস্তুটি ওভারল্যাপ করেছে, তাকে কাছের মনে হয়। এখানে পিরামিডের ছবিটি লক্ষ্য করি। আমরা সবাই সহজেই বুঝতে পারছি যে ছোট পিরামিডগুলো তুলনামূলকভাবে কাছে। কারণ, সেগুলো বড়ো পিরামিডগুলোকে ওভারল্যাপ করেছে কিংবা ঢেকে দিয়েছে। ওভারল্যাপিং পরিষ্কারভাবে নৈকট্যের হিসাব তৈরী করে।
আবার, উপরের সেজেনা পেইন্টিংটি লক্ষ্য করি। সামনের বড়ো গাছটি দূরের ব্রিজ , পাহাড় ও আকাশকে ঢেকে দিয়েছে। ওভারল্যাপিং এর কারণে আমরা বস্তুগুলো কিংবা অবজেক্টগুলোর দূরত্বটা বুঝতে পারছি।
সাইজ/পরিমাপ ও স্কেল
তুলনামূলক বড়ো বস্তু কিংবা অবজেক্ট কাছে দেখায় এবং ছোট বস্তু দূরে দেখা যায়। অন্যভাবে বলা যায়, বস্তুর সাথে দর্শকের দূরত্ব ইল্যুশন তৈরী করে। একইরকম বস্তু যদি আমরা দূরত্ব অনুসারে পরপর সাজাই, তাহলে আমরা দেখবো যে, কাছের বস্তুটিকে বড়ো মনে হচ্ছে। যদিও বাস্তবে তাদের সাইজ একইরকম।
লিনিয়ার পার্সপেক্টিভ বা একরৈখিক দৃষ্টিভঙ্গি
অনেকগুলো সামন্তরাল লাইন যদি একটি পয়েন্টে গিয়ে শেষ হয় তখন আমাদের চোখে থ্রিডি ইমেজ তৈরী করে। এই পার্সপেক্টিভ বিষয়টি ডায়মেনশন বা মাত্রা তৈরীর অন্যতম প্রধান উপাদান। এই রেখােগুলোর সমন্বয়ে টু-ডি সারফেসে থ্রিডি রিপ্রেজেন্টেশন তৈরী হয়।
রঙের ভিন্নতা
মানুষের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উষ্ণ ও উজ্জ্বল রঙের প্রতি আগ্রহ বোধ করা। যেমন, লাল, কমলা হলুদ ইত্যাদি রঙ তাকে খুব সহজেই টানে। মনোযোগ আকর্ষণ করে। অন্যদিকে অনুজ্জ্বল ও শীতল রঙ যেমন নীল ও ডার্ক পার্পল রঙ দূরত্বের ইশারা দেয়। চোখ এড়িয়ে যেতে চায় আমাদের। এবস্ট্র্যাক্ট আর্টের ক্ষেত্রেও এটি একভাবে কাজ করে থাকে।
ল্যান্ডস্কেপ কোন ফটোগ্রাফ কিংবা পেইন্টিংয়ে নীল রঙ যুক্ত করলে পাহাড়শ্রেনীকে অারো বেশি দূরের মনে হয়। নীলচে সবকিছুই মনে হয় আরো বেশি দূরত্বের। কারণ, রঙ এখানে বিভ্রম তৈরী করে।
ডিটেইল এবং টেক্সচার
আলো ও ছাঁয়ার বৈচিত্র্য
# ছবি ও তথ্য সাহায্যঃ
Phillips Collection, Washington DC