ল্যারি টওয়েল। ১৯৫৩ সালে কানাডার অন্টারিওতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বিজনেস কার্ডে লেখা ডেজিগনেশন হিসেবে তিনি একজন ‘হিউম্যান বিয়িং – ‘মানুষ’। ছোটবেলা থেকে নিজের মতো করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন এই কবি ও ফোক মিউজিশিয়ান। বাবা ছিলেন গাড়ির মেকানিক। অন্টারিওর গ্রামীন অঞ্চলের একটি একান্নবর্তী পরিবারে বেড়ে উঠেছেন ল্যারি। টরেন্টোর ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি ক্যামেরা হাতে পেয়েছিলেন। তখনই শিখেছেন কীভাবে সাদাকালো ছবি তুলতে হয়।
১৯৭৬ সালে কলকাতায় ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করতে আসেন ল্যারি। সেই সময় তিনি ফটোগ্রাফি ও লেখালেখির প্রতি উদ্বুদ্ধ হন। কানাডায় ফিরে পারিবারিক প্রয়োজনে ফোক মিউজিক শেখানো শুরু করেন। ১৯৮৪ সালে ল্যারি, ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার ও লেখক হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। তার আগ্রহের বিষয় ছিলো প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের আগ্রাসন, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নির্বাসন ও কৃষক বিদ্রোহ। তিনি নিকারাগুয়ার কনট্রা ওয়ার, গুয়েতেমালায় হারিয়ে যাওয়াদের স্বজন ও ভিয়েতনামে ফিরে যাওয়া আমেরিকানদের উপর কাজ করেছেন। তার প্রথম প্রকাশিত ম্যাগাজিন আর্টিকেল, প্যারাডাইস লস্টে আলাস্কার প্রিন্স উইলিয়াম উপসাগরে এ্যাক্সন ভেলডেজের তেল নিঃসরনের ফলে সৃষ্ট, পরিবেশগত ভয়াবহ পরিণতির কথা উন্মোচিত হয়। ১৯৮৮ সালে ল্যারি ম্যাগনাম নমিনি হন এবং ১৯৯৩ সালে পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ লাভ করেন।
১৯৯৬ সালে টওয়েল এল সালভাদরের উপর ১০ বছরের একটি প্রোজেক্ট শেষ করেন। পরপরই বের হয় তার প্যালেস্টাইন সংকট নিয়ে তৈরী ফটোবুক। ভূমিহীন মানুষের প্রতি আগ্রহ থেকে তিনি মেক্সিকোর ম্যানুনাইট উদ্বাস্তু শ্রমিকদের উপর কাজ করেছেন। দীর্ঘ ১১ বছরের সেই প্রোজেক্টটি ২০০০ সালে সম্পন্ন হয়।
বিশ্ব মিউজিক ডে উপলক্ষ্যে নেয়া সাক্ষাৎকারে ল্যারি টওয়েল জানিয়েছেন, কীভাবে মিউজিক এবং ফটোগ্রাফি একত্রে তার দৃষ্টিভঙ্গিকে সুগভীর ধারণার দিকে নিয়ে গেছে । মানুষ এবং যেসব স্থানের নানা অনুষঙ্গ তিনি নথিবদ্ধ করেন ক্যামেরায়, সেসব বিষয়কে ভালো করে অনুধাবন করতে, মিউজিক ও ফটোগ্রাফির সম্মিলন তাকে কীভাবে ঋদ্ধ করেছে, সেই গল্পই তিনি শুনিয়েছেন ম্যাগনামকে। মূল লেখাটি পড়তে এই লিঙ্কে দেখুন।
“আমার সব কাজকে একসূত্রে আটকে ফেলতে পারে একটি থিম। সেটা হচ্ছে ভূমিহীনতা। কীভাবে ভূমি মানুষের জীবনের আকৃতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করে, কী হয় সেসব মানুষের, যখন তারা ভূমিহীন ও পরিচয়হীন হয়ে পড়ে।”
আপনার প্রথম দিককার মিউজিক্যাল ইনফ্লুয়েন্স বা সংগীত বিষয়ক অনুপ্রেরণার কথা দিয়ে শুরু করছি
আমি খুব সাধারণ গ্রামের ছেলে হিসেবে বেড়ে উঠেছি। আমাদের পারিবারিক ব্যান্ডদল ছিলো। সেই সময়গুলোতে শহুরে পরিবেশে বেড়ে উঠার সাথে গ্রামের পরিবেশে বেড়ে উঠার অনেক তফাৎ ছিলো। শহুরে শিশুরা আমার কাছে অজানা আতঙ্কের বিষয় ছিলো। আমরা ৮ ভাই-বোন ছিলাম। সবাই কোন না কোন ধরণের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতাম। আমি বাজাতাম ড্রামস। আমরা কখনো কোন ধরণের মিউজিক লেসন বা সংগীত শিখি নি। কিন্তু নিয়মিত স্থানীয় বিয়েশাদি, ড্যান্স হলের প্রোগ্রাম, এবং কখনো কখনো বারে পারফর্ম করার ডাক পেয়েছি। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন মা-বাবা এবং সন্তানদের মিউজিক প্লেলিস্ট একই ছিলো। পরিবারের সবাই একই মিউজিকে গাইতাম।
৫০ এর দশকে রক এন রোল ঘরানা আসার পর তরুণরা তাদের পারিবারিক সংগীত চর্চার ধরণ থেকে সরে যায়। আলাদা ধরণের সংগীতের চর্চা বাড়তে থাকে। তাদের প্লেলিস্টের সাথে মা-বাবার প্লেলিস্ট আলাদা হয়ে যায়। আমি গ্রামীন পুরনো ধাঁচের সংগীত গাইতে গাইতে বেড়ে উঠেছি। হাঙ্ক উইলিয়ামস, আর্নেস্ট টাব, প্যাটসি ক্লাইন ছিলো আমাদের সময়ের গানের গুরু। যখন আমার বয়স ১৪, তখন আমি পারিবারিক ব্যান্ড ছেড়ে দিই। আমার কাছে মনে হতো, এটা যথেষ্ট চমৎকার বা কুল কোনকিছু না। তখন আমি শহুরে স্কুলে যেতে শুরু করেছি এবং শহুরে বন্ধুদের সঙ্গ উপভোগ করছি। হয়তো সেকারণেই এই কুল না হওয়ার ধারণাটা মাথায় এসেছিলো। সহপাঠী বন্ধুদের মাধ্যমে প্রভাবিত হওয়াটা ছিলো আমার জীবনের অন্যতম বড়ো ভুল। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে বর্তমানে টিনেজাররা মানসিক চিকিৎসা নিচ্ছে কিংবা আত্মহত্যার মতো জটিলতায় ডুবে যাচ্ছে। এটা খুব অসম্ভব কিছু না! এই বিষণ্নতাটা তারা অন্যদের কাছ থেকে ধার করছে!

©Larry Towell/Magnum Photos
আপনি কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন?
আমি আর্ট স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম এবং ভিজুয়াল আর্ট নিয়ে পড়াশোনা করেছি। আমরা দরিদ্র পরিবারের সন্তান। ১৯৬০ এবং ১৯৭০ এর দিকে কানাডাতে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের পড়াশোনা চালানোর জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা ছিলো। ফলে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে মুফতে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। তারপর আমি ইন্ডিয়াতে ভলান্টারি কাজের উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমাই। তখন আমি বিশ্বের সম্পদ বন্টন বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করি। ভিজুয়াল আর্টস বিদায় নিতে থাকে মাথা থেকে।
বৈশ্বিক শিল্প-পৃথিবী নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
আমার কাছে শিল্প-দুনিয়া একধরনের ঐকতান। একধরণের সম্মিলিত সৃষ্টি। আপনি স্কুলে যান। আর্ট বিষয়ক এমএফএ ডিগ্রি অর্জন করেন। কাজের প্রদর্শনী হয়। আপনার শিল্পসামগ্রী বেচা-বিক্রির জন্য একজন ডিলার কিংবা দালাল পেয়ে যান। এটাই সব! ইন্ডিয়া থেকে আসার পর আমি একটি কাঠের নৌকা বা ভেলাজাতীয় জলযান (র্যাফট) তৈরী করি। তারপর সেটা নিয়ে সিডেনহাম নদীতে ভেসে পড়ি। বেশ কয়েকবছর আমি র্যাফটে করে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করি।

কেমন ছিলো সেই অভিজ্ঞতা?
একাকী বসবাসে আমি অনেককিছু শিখেছি। আমি তখন জেনেছি, ধবধবে সাদা খালি-খাতার চেয়ে ভয়ের আর কিছু হতে পারে না। অভিজ্ঞতাহীন শূন্যতাই সবচেয়ে ভয়ংকর! এরপর আমার এ্যানের সাথে দেখা হয়। আমরা প্রেমে পড়ি এবং বিয়ে করি। তখন, কোন একটা কাজে ঢুকে পড়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। আমি স্থানীয় কমিউনিটি কলেজে যাই। তাদের বলি যে, আমার একটা আর্ট ডিগ্রি আছে; এখানে পড়াতে চাই। তারা আমাকে জানায় যে, তাদের নতুন কাউকে চাকরিতে দরকার নেই। কিন্তু, অন্যকিছু করার থাকলে তারা আমাকে সাহায্য করতে পারে।
সেইসময় নাইটস্কুল ধারণাটা বেশ প্রচলিত। আমি তাদের বলি যে, নাইটস্কুলে গিটার শেখাতে চাই। অথচ আমি মোটেও গিটারে ভালো ছিলাম না। তারা আমাকে ফল সিজনে গিটার শেখানোর কাজটা দেয়। আমার এক বন্ধুর কাছে জানতে চাই, রাতের স্কুলে গিটার শেখাতে হলে কী কী জানতে হবে। সে বলে, খুব অল্প কিছু জানলেই চলবে। সেই বন্ধু আমাকে মৌখিকভাবে সহজ কিছু জিনিস শিখিয়ে দিলে আমি ওর কাছে বিদায় নিয়ে চলে আসি। সেই নাইটস্কুলে পরবর্তী ১০ বছর আমি গিটার বাজানো শিখিয়েছি। বেশিরভাগ সময়ই শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলতাম। তাদের কৌতুক শোনাতাম। এবং নিজের মতো গান গাইতাম।

©Larry Towell/Magnum Photos
সেখান থেকে আপনি কীভাবে একজন ফটোগ্রাফার হয়ে উঠলেন?
সেমিস্টারের মাঝের ছুটিগুলোতে আমি সেন্ট্রাল আমেরিকার বিভিন্ন জায়গা ভ্রমণ করতে শুরু করি। তখন রিগানের সময়কাল চলছিলো। ইউএস প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান এই অঞ্চলগুলোর পরিস্থিতি বিষিয়ে তুলছিলেন। রাজনৈতিকভাবে বিরোধী-ধারণার লোকজনকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার একধরণের চেষ্টা জারি ছিলো। আমি তখন কবিতা লিখতাম। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান রেকর্ড করতাম। আর ছবি তুলতাম। খামখেয়ালে একবার আমি ম্যাগনামে কিছু ছবি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আমার কাজ ম্যাগনাম খুব পছন্দ করে। আমি যদিও তখন জানতাম না, কিসের মধ্যে ঢুকে পড়ছি।
তাহলে বলা যায় যে, ম্যাগনাম আপনার বহুমাত্রিক ক্যারিয়ারের অভ্যাসকে ফটোগ্রাফিতে নিবদ্ধ করার অনুঘটক বা মূল সহায়কের ভূমিকা পালন করেছে?
আপনি তো জানেনই জীবনে কতোকিছু ঘটে! বিশেষ করে একজন তরুনের চলার পথে। আপনি জানেন না আপনি আসলে কে। আপনি একটি দরজা উন্মুক্ত করেন। সেই দরজা আপনাকে অন্য এক প্রবেশপথের সামনে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। উন্মোচিত দরজাগুলো আরো অন্য আরো দরজার দিকে আপনাকে নিয়ে যেতে থাকে। এই যাত্রার কোন শেষ হয় না। ম্যাগনাম আমার জন্য প্রোফেশনাল দরজার দারোদ্ঘটক বা ডোর ওপেনার ছিলো।

যখন আপনি পোয়েট্রি, মিউজিক এবং ফটোগ্রাফি নিয়ে কথা বলেন, তখন স্টোরিটেলিং বিষয়টি মূখ্য হয়ে উঠে বলে মনে হয়। আপনি কি মিউজিক অথবা ফটোগ্রাফির মধ্য দিয়ে নিজের ক্রিয়েটিভিটি বা সৃষ্টিশীলতাকে প্রকাশ করা সহজ মনে করেন? নাকি মিউজিক ও ফট্রোগ্রাফি আপনাকে দুটো ভিন্ন ভিন্ন বিষয় প্রকাশে সাহায্য করে?
দুটো বিষয় অবশ্যই আলাদা জিনিস প্রকাশ করে। মিউজিক বাজাতে আপনাকে অনুশীলন করতে হবে। নিয়মিত গান গাইতে ও মিউজিক নিয়ে পড়ে থাকতে হবে। মিউজিকের জন্য অফুরন্ত সময় ও একাকীত্বের মতো বিলাসী আয়োজনের দরকার হয়। সেজন্য আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে। পুকুরপারে আমি ছোট্ট একটি ঘর বানিয়ে নিয়েছি। যেখানে আমি একাকীত্বের আনন্দ কিংবা প্রশান্তিটুকু খুঁজে পাই। এই জায়গাটুকুই আমার জন্য সংগীত সাধনার জায়গা। ফটোগ্রাফিটা সম্পূর্ণই আলাদা।
ফটোগ্রাফার অথবা মিউজিশিয়ান? নিজেকে কখনো এভাবে শ্রেণীভুক্ত করার প্রয়োজন অনুভব করেছেন কি?
দেখুন..আমি একজন ফটোগ্রাফার। আমার বেশিরভাগ কাজই দীর্ঘসময় ধরে চলা ফটো-প্রোজেক্ট। যেগুলো বিশদ আকারে বই হয়ে প্রকাশিত হয়। আমি যখন একটি ফটোগ্রাফি বই প্রকাশ করি, তখন প্রায়ই একসাথে একটি মিউজিক অথবা কবিতার সিডিও প্রকাশ করি। আমি বেশকিছু শর্টফিল্মও বানিয়েছি। এই প্রসঙ্গে টম ওয়েইটসের একটি কথা মনে করছি। “যখন তোমার কোন বিজনেস কার্ড থাকে তুমি তাতে সাইক্রিয়াটিস্ট, কার্পেন্টার ও মিউজিশিয়ান একসাথে লিখতে পারো না। কারণ, মানুষ মনে করবে আসলে তুমি কোনটাই জানো না।”

ফটোগ্রাফি একটি দৃষ্টিনির্ভর মাধ্যম। মিউজিক এবং লিরিক তেমন নয়। কিন্তু মিউজিক ও লিরিক অবশ্যই একটি দৃষ্টিনির্ভর ল্যান্ডস্কেপ বা ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরে। আপনি কি মনে করেন, ভিজুয়াল সেন্স বা দেখার সক্ষমতা বা কল্পনার প্রখরতা লিরিক তৈরীতে সাহায্য করে?
আমি এমনটা মনে করি না। আমার কাছে বিষয়টা আলাদা। ফটোগ্রাফি একধরনের ব্যাখ্যামূলক বা দৃষ্টান্ত সংযুক্ত বিষয়। আপনি যখন ছবি তুলছেন, তখন আপনি একজন প্রত্যক্ষদর্শী। আপনি যা দেখছেন, সেটাকে তুলে রাখছেন ক্যামেরায়। অন্যদিকে, আপনি যখন লিরিক রচনা করছেন, তখন আপনাকে কল্পনা বা মনোচক্ষুর উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শন আর কল্পনা, বিষযদুটো মৌলিকভাবেই বিপরীত। আমি আসলে মোটেও একজন ভালো মিউজিশিয়ান বা গায়ক নই। আমি বরং একজন গল্পকথক, একজন স্টোরিটেলার। ফটোসাংবাদিক হওয়ার অভিজ্ঞতা আমাকে এই গল্পকথনের জার্ণিতে, আমার স্টোরিটেলিংয়ে অনেক বাড়তি উপাদান যুক্ত করতে সাহায্য করে।
আপনি কতোগুলো বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারেন?
আমি বেশকিছু যন্ত্র বাজাই। কিন্তু বেশিরভাগই ভালো হয় না।
আপনি মিউজিক রেকর্ড করেন এবং লাইভ পারফর্মেন্সও করেন। তাই না?
আমি রেকর্ডিং প্রোসেস বা রেকর্ডের বিষয়গুলোকে ভালোবাসি। আমি ভালোবাসি চমৎকার মিউজিশিয়ানদের সাথে কাজ করতে। আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব আছে, যারা মিউজিক নিয়ে কাজ করে। পারফর্ম করার বিষয়টি আবার আলাদা ধরণের। আমি খুব কম সময় মিউজিক পারফর্ম করি। কারণ, চমৎকার গানের দল নিয়ে ভ্রমণ করার সাধ্য আমার হয়ে উঠে না। নিজস্ব কোন ভোক্তশ্রেনী, ভক্তকুল কিংবা বাজার-চাহিদা বা ডিমান্ড ভ্যালু নেই আমার। গান রেকর্ডকরা কিংবা লেখার চেয়ে লাইভ পারফর্মের বিষয়টি পুরোপুরি ভিন্ন জগত। উন্মুখ আগ্রহে অপেক্ষায় থাকা ভিড়ের সামনে গান করার জন্য অনেক বেশি সময় ধরে অনুশীলনের প্রয়োজন হয়। যখন আমি পারফর্ম করি, সেটা ছবি এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে ফিল্ড-রেকর্ডিংয়ের সংমিশ্রণে একধরণের মাল্টি-মিডিয়া শো হয়ে থাকে।

©Larry Towell/Magnum Photos
আপনি একবার বলেছিলেন, আপনি সেসব ছবি খুঁজে বেড়ান, যেগুলো আপনাকে ছবির ফ্রেমের বাইরের ঘটনার প্রতি আগ্রহী করে। সেই হিসেবে আপনার ছবি এবং আপনার মিউজিক প্রায়ই একই সাবজেক্ট ম্যাটার বা মূল বিষয় থেকে জন্ম নেয়। সাম্প্রতিক ক্ষেত্রেও কি তাই বলা যায়?
ফটোগ্রাফির সবচেয়ে বড়ো শক্তি হচ্ছে, ফটোগ্রাফি কোন বিষয়কে চিত্রিত করতে পারে বা বাস্তবিক অর্থে ফুটিয়ে তুলে। কিন্তু বেশিরভাগ চমৎকার অর্থপূর্ণ ছবি আপনাকে কোন অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। সেখানে ছবির সাথে আপনার একধরণের আবেগীয় সম্পর্ক তৈরী হয়। এই সম্পর্ক আপনাকে কোন না কোন ভাবে ফ্রেমের বাইরে নিয়ে যাবে। এটা শুধু আপনার দেখার সাথে সম্পর্কিত নয়। বরং আপনার অনুভবকে কীভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে, সেটাই আসল বিষয়। বিষয়টি অনেকাংশে পোয়েট্রি বা কাব্য রচনার মতো। কার্ল স্যান্ডবার্গ বলেছেন, দরজা খোলা এবং বন্ধ হওয়ার মাঝে মূল বিষয় হচ্ছে, এটি মানুষকে ভাবতে আগ্রহী করে যে, দরজার উপারে তারা কী দেখেতে চাইছে।
আপনার যে সিডিগুলো ডকুমেন্টারিতে সংযুক্ত থাকে ( যেমন ম্যানুনাইট কলোনী বা ইস্ট জেরুসালেম ) সেগুলো, সংবাদ কাহিনীর মূলবিষয় বুঝাপড়ার ক্ষেত্রে নতুন কোন স্তর বা লেয়ার যুক্ত করে কি?
এটা আসলে বুঝাপড়া কিংবা উপলব্ধির বিষয় না। বরং এটা মূলত অনুভবের বিষয়। মানুনাইট কিংবা আফগানিস্তান ইত্যাদি কাজের উপর আমার ফিল্ড-রেকর্ডিংয়ের আর্কাইভ রয়েছে। আমি যদি পোয়েট্রি কিংবা লিরিকস রেকর্ড করি, তাহলে আমি প্রায়ই ফিল্ড-রেকর্ডকে অডিও-ট্র্যাকের সাথে সহায়ক উপাদান হিসেবে ব্যবহার করি। যেমন, অন্যরা সহায়ক হিসেবে গানের সাথে পিয়ানো কিংবা ভায়োলিন ব্যবহার করে থাকে। যখন প্রথম ঢিএটি রেকর্ড বের হয়, তখন থেকে আসলে আমি ম্যানুনাইট রেকর্ড করতে শুরু করেছিলাম। তাই, যে রেকর্গুডগুলো আমি ওল্ড কলোনীতে তৈরী করেছিলাম, আপনি ম্যানুনাইট সিডিতে সেসব রেকর্ডিং শুনতে পাবেন।

আপনার এ্যালবাম- ম্যানুনাইটস – সাউন্ড রেকর্ডিং, মৌখিক শব্দ, প্রাকৃতিক বাদ্যযন্ত্র ও এইরকম আরো নানাবিধ বিষয়ের সমৃদ্ধ একটি ক্যানভাস। একদল মানুষকে বুঝার ক্ষেত্রে কীভাবে এই জটিল গানগুলো পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারে?
শব্দ আপনাকে অনুভব করতে শেখায় যে, আপনি আছেন। ম্যানুনাইটরা জনবিচ্ছিন্ন কলোনীগুলোতে বাস করা ভীষণ নির্জন একদল মানুষ। তাদের নিজস্ব জীবনধারণ পদ্ধতিকে বাঁচিয়ে রাখতে তারা মাইগ্রেট করতে বা উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়েছে। আমি তেমন কিছু পরিবারের সাথে খুব আন্তরিকভাবে সংযুক্ত থেকেছি এবং ১০ বছর ধরে তাদের অনুসরণ করেছি। ছবি তোলার পাশাপাশি আমি তাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনের নানা বিষয়ে ছোটখাটো নোট নিয়েছি। যেগুলো আমাকে তাদের উপর কাজে সহায়তা করেছে। আমার নোট লেখার আগে এই খুটিনাটি বিষয়গুলো আমার নজরে পড়ে নি। তারপর সেই সংক্ষিপ্ত অনুষঙ্গগুলো রেকর্ডিং স্টুডিওতে নিয়ে কাজ করেছি জেফ বায়ার্ডের সাথে। বায়ার্ড আমার একজন মিউজিশিয়ান বন্ধু। জেফ কাউবয়-জাঙ্কিদের সাথে মিউজিক করে। আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, ক্লাসিক্যাল মিউজিক ও ফিল্ড-রেকর্ডিংয়ের সংমিশ্রণে এই বইয়ের সাউন্ডট্র্যাক তৈরী করবো।
আমরা দু’জনে মিলে শব্দগুলো (ওয়ার্ড) শুনিছি। চেষ্টা করছি খুঁজে বের করার যে, কোন্ জাতীয় ধ্বণি বা সাউন্ড সেসব শব্দকে (ওয়ার্ড) ধারণ করতে পারে। কখনো সেটা ছিলো বাতাসের ধ্বনি অথবা কোন বিশেষ যন্ত্রের সংগীত। আমরা তখন তাতে নতুন কোন ধ্বণি ও শব্দ (ওয়ার্ড) যুক্ত করে ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা করেছি। তাতে গিটার ও অনুপম কোন ধ্বণি সংযোজনের চেষ্টা করেছি। যাতে মিশ্রিত ছিলো, ম্যানুনাইটদের বাড়ির রান্নাঘরের টেবিলে রাখা আলোর চারপাশ ঘিরে সবাই মিলে গান গাওয়ার ধ্বণি। কিংবা ছিলো বাতাসের অনুরণন। অথবা, কখনো সে ধ্বণি ছিলো উষর মরুভূমির রাতে কুকুরের হাকডাক। আমাদের পদ্ধতিটি ছিলো এই সবকিছুকে একসাথে মিলিয়ে একটা নতুন কিছু করার। পুরো বিষয়টি ফটোগ্রাফি করার চেয়ে সম্পূর্ণ রকমে আলাদা। এটার অভিজ্ঞতাটি অনেকাংশে অন্ধ হওয়ার মতো। আপনি যা দেখছেন সেগুলোর কোনটার ধ্বণি আপনি শুনতে পান না। অথচ আপনি যা শুনছেন তা দেখতে পান।
Lecture: Larry Towell (2013 Sem Presser) from World Press Photo on Vimeo.
যখন আপনি কোন সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে কাজ করেন, এই পদ্ধতি কি ভিন্ন হয়? উদাহরণ হিসেবে আপনার ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ নামের কবিতাটি নিয়ে আমাদের বলতে পারেন? এবং এর নেপথ্যের গল্প টি?
২০০৩ সালে ইজরাইল-প্যালেস্টাইনের উপর করা ২য় বইয়ের জন্য আমি কার্টিয়ার-ব্রাঁসো ইনাগোরাল এওয়ার্ড পাই। ততোদিনে অবশ্য গাজায় বেশকিছু কাজ করা হয়েছে আমার।
আমি তখন অবরুদ্ধ ইস্ট জেরুসালেমে ছিলাম। সেই জার্ণিতে প্রচুর বৃষ্টিপাতের সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। দিনের বেলা সাধারণত ওয়েস্টবাঙ্কের দিকে যেতাম। প্রায়ই যেখানে আগেরদিন কোন গ্রামে ইজরায়েলি হামলায় মৃতদের শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হতো। কখনো আবার আমি বেথেলহেমে চলে যেতাম। উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াতাম ও ছবি কুলতাম। গাজার মতোই ছিল আমার রুটিন। কিন্তু, সেবার যেহেতু প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিলো, আমি তখন বেরুতাম না। নিজের রুমে বসে লিখতাম। সেই সময়গুলোর অভিজ্ঞতা নিয়ে সিরিজের মতো করে লিখে গিয়েছি। প্যালেস্টাইন সিডি, সেই ট্রিপেই লেখা হয়েছিলো। সেই লেখাগুলো রেকর্ডিং স্টুডিওতে নিয়ে আসি। এবং তাতে মিউজিশয়ানদের যুক্ত করি। আমি গুয়েলফ এবং কানাডাতে স্কট মেরিটট এর সাথে কাজ করেছি।
বলা যায়, ইস্ট জেরুসালেমে আরব-কোয়ার্টারের মধ্য দিয়ে একরাতের মনোযোগী পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে নো ম্যানস ল্যান্ডের কাব্যসমূহের সৃষ্টি। এটা কি সত্য কাহিনী? নাকি এটা সত্য কাহিনী নয়? আসলে, এটা একটি কাব্য, একটি কবিতা। যা আপনাকে অদৃশ্য কিংবা অশরীরি উপায়ে ছুঁয়ে যাবে। আমি সেখানে শুনতে পাই বেড়ালের আওয়াজ। আমি শুনতে পাই পায়ের শব্দ। আমি শুনতে পাই পুরনো শহরের গভীর থেকে উঠে আসা অনুরণন। আকাশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ঝিকমিকে তারা, জলপাই রঙা পোশাকের সৈনিক..ছোট্ট ছোট্ট পর্যবেক্ষণ এখানে ক্রমশ হয়ে উঠে চমৎকার কোন রূপক।
এটা পুরোপুরি অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে?
হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আমি এখানে এই ধরণের কাজে আছি। কারণ, আমি সংঘাত নিরসনে আগ্রহী। আর ইজরাইল-প্যালেস্টাইন সংঘাত অবশ্যই অন্যতম বৃহৎ সমস্যা। আমি আবার ফিরে গিয়েছিলাম দেখার জন্য। বিশেষ করে প্যালেস্টাইনীদের জীবনকে জানার জন্য, যারা সম্ভবত পৃথিবীর সবচে নিগৃহীত মানুষ।
আমি যেসব বিষয়ের সম্মুখীন হয়েছি, সেগুলো বেশিরভাগই ছিলো ভূমি-সংশ্লিষ্ট এবং উচ্ছেদ সম্পর্কিত। সেটা প্যালেস্টাইন, সেন্ট্রাল আমেরিকার কৃষিজীবি কিংবা নর্থ আমেরিকার ফার্স্ট-নেশন কমিউনিটি (একটি আদিবাসী গোষ্ঠী), সবার ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রভাব ফেলছে। অন্যদের রাজত্ব কিংবা সাফল্য মেনে নেয়ার জন্য আমরা তৈরী নই।
আপনি কি আপনার ‘রিফিউজি’ গানটির ব্যপারে আমাদের একটু বলতে পারেন?
গানটি শুনুন। এটা একটি সত্য ঘটনা।
আপনি কি যুদ্ধের গান লিখেন?
প্যেটে সিগ্যের যুদ্ধের গান লিখেছিলেন। তিনি সেগুলোকে আন্দোলনের গান বলতেন। জাস্ট এনাদার ম্যাসাকার হচ্ছে একটি প্রতিবাদী সংগীত। তেমনই রিফিউজি এবং দ্যা ম্যান আই লেফট বিহাইন্ডও প্রতিবাদের গান।
‘জাস্ট এনাদার ম্যাসাকার’ গানটি কীভাবে আসলো? কেনোই বা লিখলেন?
এটার শুরু ছিলো অনেকদিন আগে। ১৯৮৪ সালে নিকারাগুয়ার একটি রিফিউজি ক্যাম্প ভ্রমণের সময় টুকরো কিছু কবিতাংশ লিখেছিলাম। এই ক্যাম্পে ১৯৭০ থেকে ১৯৮০র সময়কালে যেসব সালভাদরানরা হত্যাকান্ড থেকে পালাতে পেরেছিলো, তাদের বসবাস ছিলো। আমি সাম্প্রতিক সময়ে একটি কর্ড-প্যাটার্ণ ( গান কিংবা সঙ্গীতের একধরণের যৌগিক সূর ) তৈরী করি। তারপর নতুন কিছু কবিতাংশ ও শব্দ সেই কর্ডের সাথে জুড়ে দিই। তৈরী হয় জাস্ট এনাদার ম্যাসাকার।
আপনার ফার্স্ট-নেশন্স কাজগুলোতে ধ্বনি অথবা সাউন্ড এবং মিউজিকের কোন ভূমিকা আছে কি?
আমরা সবাই সেটা দেখতে পাবো। আমি ভিডিও শুট্যিং করছি। অডিও রেকর্ডিং চলছে। দেখা যাক কী হয়! নিজেকে ফার্স্ট-নেশনের একজন ব্যক্তির মনোজগতে বসিয়ে, তাদের গল্প বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবো না। কারণ, তাদের স্টোরি বলার জন্য নিজস্ব শক্তিশালী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তারা যাচ্ছে। আমি এই বিষয়টির প্রতি, তাদের নিজস্ব ধরণের প্রতি সহানুভূতিশীল। কিন্তু, যখনই মিউজিক ও সাউন্ড আমার দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রকাশ করে, তখন অবশ্যই নিয়মমাফিক এদের ভূমিকা থাকে।

আপনার প্রিয় কোন নায়কের কথা বলুন যিনি আর্টিস্ট?
ফেডেরিকো গার্সিয়া লোরকা। তিনি ছিলেন স্পেনিশ সিভিল ওয়ারের নাট্যকার, কবি ও গায়ক। লোরকা বলেছিলেন, শিল্পের খাতিরে শিল্পের ধারণাটি যন্ত্রনাদায়ক হবে। সেটা যদি না হয়, তাহলে ভাগ্যক্রেমে সেটা হবে হাস্যকর। তৎকালীন সেনাশাসক ফ্রান্সিসকো ফ্রাংকো বাহামন্ডের আদেশে তাকে অপহরণ করা হয়। ফ্রাংকোর আজ্ঞাবহ সেনাধ্যক্ষরা তার মৃত্যুদন্ড বাস্তবায়ন করেছিলো। জীবন দিয়ে লোরকা তার মুক্তচিন্তার মূল্য পরিশোধ করেছিলেন। সেইসময়ে সাংবাদিকদের জন্য এই একই শাস্তি বরাদ্দ ছিলো।
# Feature Photo Credits: Aaron Vincent Elkaim । # পোস্টে ব্যবহৃত সকল ফটোগ্রাফ তুলেছেন ল্যারি টওয়েল। সকল স্বত্ত্ব ম্যাগনাম ফটোস কর্তৃক সংরক্ষিত । # All Photos Used in This Post , Captured by Larry Towell. All Rights Reserver by Magnum Photos.