ফার্দিনান্দ সিয়েন্না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইতালিতে জন্ম নেয়া ফটোগ্রাফার। ৬০ এর দশকে ইউনিভার্সিটি অব পালের্মোতে সাহিত্য, দর্শন ও কলা-ইতিহাস নিয়ে শিক্ষাগ্রহণ করেন। তখন থেকেই তার ছবি তোলার সময় শুরু। সিসিলির স্থানীয় মানুষজনের ছবি তোলার মধ্য দিয়ে ফটোগ্রাফি কিংবা ক্যামেরায় মুহুর্ত অনুসন্ধানের সুবিশাল দুনিয়ায় পা রাখেন এই মেধাবী চিত্রকর। ১৯৬৬ তে সিসিলি থেকে মিলানে চলে আসেন। শুরু করেন লেখালেখির নতুন জীবন। সাথে সমানতালে চলতে থাকে ছবি তোলা।
১৯৭৩ এ সাংবাদিক হিসেবে শুরু করেন নতুন জার্ণি। তারপর থেকে কখনো থামেন নি তিনি। নানা নামী পত্রিকা আর ম্যাগাজিনে কাজ করেছেন। ১৯৮২ তে যোগ দেন বিখ্যাত ফটোগ্রাফিক কো-অপারেটিভ ম্যাগনাম ফটোসে। পেয়েছেন বিভিন্ন পুরষ্কার। লিখেছেন ২০ টিরও বেশি বই। ঘুমন্ত মানুষের ছবি নিয়ে কাজ করেছেন ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। ম্যাগনাম ফটোতে তিনি খুব সংক্ষেপে ধারণা দিয়েছেন তার এই সিরিজ নিয়ে। সেই অংশটির বাংলায়ন (সরাসরি অনুবাদ নয়) তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
ঘুম জীবনের অন্যতম রহস্যময় এক অব্যাখ্যাত অনুষঙ্গ। একইভাবে স্বপ্নও। ফার্দিনান্দ সিয়েন্না লিখেন, ‘মানুষ কেনো ঘুমায়, এই কথাটি চিরদিনই সে জানতে চেয়েছে।’ একজন সাধারণ মানুষের জীবনের তিনভাগের একভাগ কেটে যায় ঘুমে। এই ঘুমন্ত টাইমফ্রেমের প্রায় ছয় বছর কাটে স্বপ্নে! অন্য পৃথিবী যেখানে স্বপ্নের বসবাস, সেখানের নিয়ম অনুসারে মানুষের স্বপ্নে আরকেউই নাক গলাতে পারে না। মানুষ তাই নিজস্ব জগতে নিজের নিয়মে ঘুমিয়ে থাকে। চুপচাপ। নিজের সপ্নজগত অন্যদের অজানাই থেকে যায়। হয়তো তারও অজ্ঞাতেই পড়ে থাকে পৃথিবীর রহস্যময় এক সুবিস্তৃত চ্যাপ্টার।

ফার্দিনান্দ তার বই ‘ঘুম, হয়তো স্বপ্নের জন্য নিরন্তর জার্ণি’ তে ( to sleep, perchance to dream (1997) উন্মোচন করেছেন সিয়েন্নার দীর্ঘ সময়ের কাজের ফলাফল। প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি একটি থিম নিয়ে কাজ করেছেন। যেখানে সিয়েন্না ধরতে চেয়েছেন বিমূর্ত কিছু মুহুর্ত। আপাত গতিহীন কিন্তু চলমান সময়ের কিছু টুকরোকে। তিনি খুঁজে ফিরেছেন কোন ‘হারিয়ে ফেলা শূন্যতার ছাঁয়া’। ‘আমি বিভিন্ন সময় ও আয়োজনে খেয়াল করে দেখেছি, আমার অসংখ্য ছবি রয়েছে ঘুমন্ত মানুষের। ফটোগ্রাফি জীবনের শুরু থেকেই আমি সুযোগ পেলে ঘুমন্ত মানুষের ছবি তুলেছি।’
তার কাব্যিক, সাদাকালো রঙহীন কিংবা মেলানকলিক ঘুমন্ত মানুষের ছবিগুলো কথা বলে। গল্প শোনায় আমাদের অন্যের একান্ত অজ্ঞাত কোন পৃথিবীর উইন্ডোতে উঁকি দিয়ে দেখার অদম্য ইচ্ছার। যে মানুষগুলো হয়তো ঘুমিয়ে ছিলো নিজেদের বাড়িতে, কঠিন শহরের রুক্ষ মেঝেতে কিংবা প্রিয় কারো কোলে মাথা রেখে।
ঘুম আপনাকে অথবা আপনার চোখের রঙকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নেয়।– পল ইলার্দ

‘ঘুম শুধুমাত্র বিশ্রামের সময়ই নয়। বরং একইসাথে জীবনের সাথে সংযুক্ত অন্য এক স্বপ্নের সাগরের প্রবেশদ্বার।’ সিয়েনা এভাবেই লিখেন। স্বপ্ন পৃথিবীজুড়ে পরিচিত অনুষঙ্গ হলেও এটি মানুষের ভাবনা-বিশ্বাস-অবস্থা-ব্যক্তিত্বের সাথে সাথে নিজের মতো করে রূপ পাল্টায়। কেউ যখন বলছেন, স্বপ্ন আমাদের নিজস্ব চিন্তা, ধারণা, বিশ্বাস, আকাঙক্ষা, ভয়, দ্রোহ ইত্যাদির প্রতিফলন ঘটায়। ঠিক তখনই অন্যকেউ বলছেন, স্বপ্ন আমাদের আত্মাকে পৃথিবীর উপারের কোন জগতে পরিভ্রমণের বাহন হিসেবে কাজ করে। নশ্বর শরীর তখন বিছানায় কিংবা কারো কোলে পড়ে থাকে অচেতন। ঘুমের মধ্যে আমাদের সচেতন মনের পরিবর্তে অবচেতন মন জীবনের চিহ্নকে বহন করে।
(অনুবাদকের ঘুমন্ত মানুষ নিয়ে একটি আর্টিকেল রয়েছে। পড়তে চাইলে এখানে দেখুন)
একজন ঘুমন্ত মানুষকে দেখার অভিজ্ঞতা ভীষণরকম আলাদা। জেগে থাকা কাউকে পর্যবেক্ষণের চেয়ে পুরোপুরিই ভিন্ন। প্রথমত, সেখানে কোন চাহিদার, আকাঙক্ষার, স্বার্থের, লোভের ছাঁপ থাকে না। শারিরীক নিরাপত্তা বলয়ের অনুপস্থিতি থাকে। থাকে নিত্যদিন অভিনয় করে বেঁচে থাকা মুখোশের অভাব। ঘুম আমাদের বিপদজনকভাবে উন্মুক্ত করে দেয়। সিয়েনা বলছেন, ‘আমরা যখন কারো সাথে নিরাপদ জায়গায় ঘুমিয়ে থাকি, তখন আমরা এটা মেনে নিয়েই থাকি যে, আমরা অন্যদের কাছে উন্মুক্ত কিংবা প্রতিরক্ষা বলয়ের বইরে।।’ অর্থাৎ ঘুমন্ত আমরা অনেক বেশি অনিরাপদ থাকি।

সিয়েন্না সবসময়ই সচেতন ছিলেন, যাতে তিনি ঘুমন্ত ব্যক্তির প্রাইভেসি কোনভাবেই নষ্ট না করেন। তিনি লিখেছেন, ‘এই ছবিগুলোর মধ্যে সুন্দর বিছানায় শুয়ে থাকা বালিকাটি আমার মেয়ে। এই ছবিটিও অসাবধানতায় তোলা হয় নি।’ তিনি তার মেয়ের জন্য যেভাবে ভাবেন, তার বিভিন্ন চরিত্রদের জন্যও সেভাবেই চিন্তা করেন। সেরকমই সচেতনতা অবলম্বন করেছেন।
যে সকল চরিত্র কিংবা মানুষেরা সিয়েন্নার এই সিরিজকে সমৃদ্ধ করেছে, তারা বিভিন্ন রকমের বৈশিষ্ট্য বহন করে। একজন ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায় পড়ন্ত রোদে শুয়ে থাকা ক্লান্ত এবং হতাশ ব্যক্তি , অভিব্যক্তিহীন একজন মাইনার, একজন দরিদ্র তরমুজ বিক্রেতা, সূর্যালোকিত গ্যালারির জানালায় পোঁজ দেয়া একজন পারফর্মেন্স আর্টিস্ট, সচেতন পিতামাতার কোলে ঘুমন্ত শিশু, বিধ্বস্ত-ক্লান্ত তীর্থযাত্রী আগন্তুক কিংবা উদ্বাস্তু, গৃহহীন কেউ – এমনকি মালিকের পাশে হেঁটে যাওয়া অবশ্রান্ত গরু- এরা সকলেই ঘুমের জগতে একসরিতে নেমে আসে।
আমি একধরণের কালিক কিংবা সময়নির্ভর ফটোগ্রাফির চর্চা করি-যা নির্ধারিত আকার, চিত্র, গল্প তৈরী করতে সক্ষম।’ – ফার্দিনান্দ সিয়েন্না
তাদের মধ্যে কোন তফাৎ থাকে না। থাকে না কোন আরোপিত অহংবোধ। হয়তো একারণেই তাদের ঘুম উদ্দেশ্যপূর্ণভাবেই উত্তরহীন পড়ে থাকে। ছবিতে যুক্ত করে সুগভীর রহস্য। সিয়েন্নার দৃষ্টিতে তার বিষয়বস্তুরা ঘুমায় অজানা কারণ কিংবা অমিমাংসিত অবস্থায়। হয়তো কখনো প্রয়োজনে, কখনো আবার নিস্পাপ অকারণে আবার কখনো নিতান্তই ক্লান্তিতে। হয়তো ঘুমন্ত মানুষের হারানোর কিছু থাকে না বলেই এমন করে ঘুমাতে পারে তারা।

সিয়েন্নার কাছে ফটোগ্রাফি এবং ঘুম ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত ও সম্পর্কিত। ‘আমি একধরণের কালিক কিংবা সময়নির্ভর ফটোগ্রাফির চর্চা করি-যা নির্ধারিত আকার, চিত্র, গল্প তৈরী করতে সক্ষম।’ একইসাথে এটি উন্মোচন করে সময়কে কিংবা সময়ের ভেতরকার কোন অর্থকে। একটি ছবি সবসময়ই নিরন্তর পরিবর্তনশীল জীবনের চলমান কোন মুহুর্তকে থামিয়ে দেয়া কিংবা ফ্রিজ করে দেয়ার সুযোগ দেয়।

কিন্তু, সিয়েন্না বলছেন, তিনি আমাদের জীবনের এমন অংশকে ধারণ করেন, ক্যামেরায় ধরে রাখেন যা মূলত অচলিষ্ণু কিংবা গতিহীন, কিন্তু, কোনভাবেই স্থগিত কিংবা থেমে যাওয়ার নয়। সিয়েন্না ব্যাখ্যা করছেন, ফটোগ্রাফারের জীবনের ফ্রিজ মোমেন্ট কিংবা ক্ষণ তখন ঘুমন্ত মানুষের জীবনের সেই মোমেন্টের কিংবা কালের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। একইভাবে ঘুমন্ত মানুষের থমকে যাওয়া মুহুর্ত যুক্ত হয় ফটোগ্রাফারের জীবনের কোন অংশে। ঘুমন্ত মানুষ তখন তার নিজস্ব পৃথিবী থেকে ফটোগ্রাফারের সচেতন সময়ে এসে হাজির হয়।
একধরণের টাইম ট্রাভেল কিংবা সময়ের পকেটে আটকে যায় মানুষের অভিজ্ঞতা। ফটোগ্রাফি এখানে বাহন হয়ে দাঁড়ায়। সময়ের খন্ডিত টুকরোগুলো হয়তো তৈরী করে অন্যকোন নতুন গল্প। যে গল্প রহস্যময় কোন জগতের ‘খাবনামাহ’ (স্বপ্নের বার্তা) রেখে যায় আমাদের জন্য।
# পোস্টে ব্যবহৃত সকল ফটোগ্রাফ তুলেছেন ফার্দিনান্দ সিয়েন্না। সকল স্বত্ত্ব ম্যাগনাম ফটোস কর্তৃক সংরক্ষিত । # All Photos Used in This Post , Captured by Ferdinando Scianna. All Rights Reserver by Magnum Photos.