নরসিংদী জেলার মাধবদী। তখন সকাল 9 টা বাজতে 10 মিনিট বাকী..। দিগন্তের কোণ দখল করে কালো হয়ে আসছে আকাশ..। তীব্র বাতাসের ঝাপটায় রাস্তায় ধূলোবালি আর পরিত্যক্ত মোড়কের ঝড় উঠছে..। একটা সাইকেল তখন চলছে বাতাসের বিপরীতে…। মাথা নীচু করে সাঁই সাঁই প্যাডেল করছে আরোহী..। যেতে হবে আরো খানিকটা দূর…। ভোরে ঢাকার বাসাবো থেকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ভেতর দিয়ে বালু নদী পেরিয়ে কাঞ্চন হয়ে চলেছি নরসিংদী সদরের পথে..।
বৃষ্টি কিংবা প্রকৃতির অপরূপ পালাবদল দেখতে দেখতে চলেছি আমার দু’চাকার বাহনে। 300 ফিট রাস্তায় পার হয়ে এসেছি অসম্ভব সুন্দর একটা মুহুর্ত। রাস্তার সামনে যতদূর চোখ যাচ্ছে, ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। আমি যে অংশে আছি সেখানে শুকনো খটখটে..। একটু পর শুকনো অংশ থেকে বৃষ্টিভেজা আঙিনায় প্রবেশের মতো করে ভিজে উঠলাম আমি আর আমার সাইকেল..। কখনো হুটহাট বৃষ্টি ভিজিয়ে দেয়া কখনো চরম রোদের তাপ উপেক্ষা করে চলছি…।
রূপগঞ্জ এবং মাধবদীতে স্বল্প-বিরতী দিয়ে চলে আসলাম নরসিংদী সদরে..। তারপর আবার ফিরতি যাত্রা..। সোলো রাইডে এই প্রথম এতোটা দূরত্ব একা পার হচ্ছি..। আসার পথে প্রথম বাংলা কোরআনের অনুবাদক গিরীশচন্দ্র সেনের বাড়ির সাইনবোর্ড দেখে থামলাম..। অবাক ব্যাপার হচ্ছে, অনেকক্ষণ খুঁজেও পাচ্ছিলাম না বাড়িটা..। পরে একজন স্থানীয়কে বলাতে তিনি আমাকে দেখিয়ে দিলেন বাড়িটা। ভীষণ বিস্ময় আর কষ্টে নির্বাক হয়েছিলাম..। যে বাড়িটা উনি দেখিয়েছিলেন, সেটা আর যাইহোক, কোনভাবেই বাড়ি বলা চলে না। শত বছরের পুরোনো ইটের দেয়াল, আবর্জনাপূর্ণ চারপাশ, দেয়ালে বড়ো বলো পরগাছার জড়াজড়ি দেখে মনটা খারাপ লেগে উঠলো…।
এই সেই ভাই গিরিশচন্দ্র সেন, যিনি বর্তমান নরসিংদী জেলার পাঁচদোনা গ্রামে এক বিখ্যাত দেওয়ান বৈদ্যবংশে জন্মগ্রহণ করেন। গিরিশচন্দ্রের পিতা ছিলেন মাধবরাম সেন এবং পিতামহ ছিলেন রামমোহন সেন। গিরিশচন্দ্ররা ছিলেন তিন ভাই। ঈশ্বরচন্দ্র সেন, হরচন্দ্র সেন এবং সর্বকনিষ্ঠ গিরিশচন্দ্র সেন। ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের পরিবার ছিল অত্যন্ত গোঁড়াপন্থি। পরিবারে সনাতন ধর্মের আচরণ প্রয়োজনের তুলনায় একটু বাড়াবাড়ি রকমভাবেই মেনে চলা হতো। এমন একটি কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিবারে জন্ম নিয়েও গিরিশচন্দ্র সেন একজন সম্পূর্ণ সংস্কার মুক্ত মানুষ হয়েছিলেন। অন্য ধর্মের উপর গবেষণা করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
তিনি কুরআন শরীফের সম্পূর্ণ অংশ, মিশকাত শরীফের প্রায় অধিকাংশ, হাদিস, তাজকিরাতুল আউলিয়া, দিওয়ান-ই-হাফিজ, গুলিস্তাঁ, বুঁস্তা, মকতুব্বত-ই-মাকদুস, শারফ উদ্দিন মুনিবী, মসনভী-ই-রুমী, কিমিয়া-ই-সাদত, গুলশান-ই-আসরার ইত্যাদিসহ বহু ইসলামি গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেন। মুক্তমনা ও অসাধারণ মানুষ ভাই গিরিশচন্দ্র সেন ১৯১০ সালের ১৫ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।
মৃত্যু মানুষের সবকিছু মুছে দেয়…। গিরিশচন্দ্র সেনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। একসময়ের এই বিদ্যানুরাগী প্রভাবশালী মানুষটির বাড়ি এখন আর কারো আগ্রহ জাগায় না। নেই সেখানে তার কোন স্মৃতিচিহ্ন..। কালের বিবর্তন আর আমাদের অবহেলায় ভগ্নপ্রায় বাড়ির ধ্বংসাবশেষটুকুও হয়তো খুব শীঘ্রই মুছে যাবে চিরতরে..।
মাধবদী থেকে বেরিয়ে ভুলতার পথে চলছি..। দুপুরের রোদ চরমভাবে তেঁতে উঠেছে ততোক্ষণে..। একজায়গায় এসে হঠাৎ সাইকলের কাদাজড়ানো চাকা স্লিপ কাটলো..। ছোট্ট একটা এক্সিডেন্ট…। হেলমেট না থাকলে বড়োকিছু হলেও হতে পারতো..। কিছুক্ষণ রেষ্ট নিয়ে আবার পথ চল…। রাস্তায় খেয়ে নিয়েছি গৈারব মিষ্টান্ন ভান্ডার নামের অখ্যাত এক দোকানের দারুণ মজাদার মিষ্টি…। তারপর এবার কাঁচপুর হয়ে ঢাকার বাসাবোতে…আমার বাসায়…। ততোক্ষণে পার হয়ে এসেছি প্রায় 122 কি:মি: পথ..।
পথ, প্রকৃতি এবং মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখার তৃষ্ণা আমার কখনোই মিটবে না। সাইকেল আমাকে সাহায্য করে চলেছে এই পদযাত্রায়..। নির্জন রাস্তায় সাইকেলের ঝিমধরানো শব্দ আমার নেশা ধরিয়ে দেয়…। প্যাডেল ঘুরাতে গিয়ে মনে হয় অনন্তকাল ধরে চলতে থাকতাম আমি আর আমার সাইকেল..। কোন গন্তব্য না থাকতো…কোথাও যাওয়ার কিংবা জীবনের সব প্রয়োজন ফুরিয়ে যেতো যদি…।
সাইকেল আমাকে প্রতিনিয়ত শেখাচ্ছে জীবনকে নতুনভাবে দেখতে..। খুব অল্পদামের হলেও ভীষণ বিশ্বস্ত আর প্রিয়, ফনিক্স সাইকেলে আমি ছুটে চলছি…। এই নাগরিক জীবনের প্রতিযোগীপূর্ণ সময়ে, সাইকেল আমাকে ভালোথাকার শক্তি জোগায়…। দেয় উদ্দাম আনন্দ আর শর্তহীন সাহচার্য….শেখায় জীবনের কঠিন সময়গুলোতে থেমে যাওয়া আর চলতে শুরু করার জটিল ব্যকরণ…। চলুক দু’চাকার এই আদিম বাহন..বয়ে আনুক আমাদের জন্য গতিশীল এবং সুনির্মল ভালোবাসা…। হ্যাপি সাইক্লিং…